কাজী সালমা সুলতানা
[শেষপর্ব]
লক্ষ্মীপুর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে এক নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেদিন পাকিস্তান হানাদাররা অতর্কিত হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন করে বহু মানুষকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আটঘরিয়ার দেবোত্তর, বংশীপাড়া, গড়রী, আটঘরিয়া বাজার এবং একদন্তের বেলদহ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় লক্ষ্মীপুর গ্রামে। এছাড়া এদিন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, দেশবরেণ্য লালনগীতি শিল্পী ও পল্লি চিকিৎসক এমএ গফুরকে পাকিস্তানি হায়েনারা নির্যাতন ও বেয়নেট চার্জ করে এবং পরে রাজাকাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আটঘরিয়ার পার্শ্ববর্তী হাদল এবং ডেমরায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা হানা দিয়ে শত শত লোককে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। ওইসব গ্রামের নারী-কিশোরী এমনকি শিশুদেরও পাকিস্তানি পিশাচরা ধর্ষণ করে। ডেমরা গণহত্যায় পাকিস্তানি হায়েনারা প্রায় সাড়ে আটশত লোককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।
সেদিন ২০ আগস্ট, শুক্রবার দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা। গ্রামের মানুষ স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অতর্কিত পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসররা সেখানে আক্রমণ করে গুলি শুরু করে। গ্রামের বহু মানুষকে তারা আটক করে। পুরুষদের ধরে এক জায়গায় জড়ো করা হয়। এরপর তারা নারীদের ওপর নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। বহু মানুষকে তারা ইছামতি নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। শুধু লক্ষ্মীপুর গ্রামের ২৮ জনকে সেদিন হত্যা করা হয়। এ ছাড়া অনেককে পথ থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়।
শালিহর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট ময়মনসিংহের গৌরীপুরে শালিহর গণহত্যা সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে গিয়ে সেদিন শালিহর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা গ্রামের ১৪ জনকে আটক ও পরে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী এ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হাসিমের বাবা ছাবেদ হোসেন বেপারিকে ও এর আগে ১৬ মে ধরে নিয়ে যায় সাংবাদিক সুপ্রিয় ধর বাচ্চুর বাবা মধুসূদন ধরকে। তারা আর ফিরে আসেননি।
শালিহর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছেÑএমন ভুল খবর পেয়েই মূলত পাকবাহিনী গ্রামটিতে হানা দেয়। পাকবাহিনী আসছে খবর ছড়িয়ে পড়লে শালিহর গ্রামের নারী-পুরুষ যার যার মতো দৌড়ে পালাতে থাকে। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের প্রথমেই সামনে পড়ে যান কৃষক নবর আলী। পাকবাহিনী নিরীহ নবর আলীকে গুলি করে হত্যার পর পুরো শালিহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই দিনে শালিহর গ্রামের নানা স্থান থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৪ জনকে।
সেদিন পাকসেনারা পশ্চিম শালিহর গ্রামে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর তারা ১০-১২টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এর আগে আলবদর কমান্ডারের নেতৃত্বে এসব বাড়িতে লুটতরাজ চালানো হয়। পাকসেনাদের সহায়তায় ছিল ময়মনসিংহ শহরের বাঘমারা এলাকা থেকে আসা বদর বাহিনীর সদস্যরা। আব্দুল মান্নান ফকির ছিল বদর বাহিনীর কমান্ডার। পশ্চিম শালিহর গ্রামের কয়েকটি জায়গায় হত্যাযজ্ঞ হয়। সেখানে বদ্ধভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও, সেখানে গণহত্যায় শহিদদের কোনো নাম-পরিচয়ের তালিকা রাখা হয়নি।
পাকুড়িয়া গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভয়াবহ পাকুড়িয়া গণহত্যা ঘটে। সারাদেশের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে ওঠে, তখন নওগাঁর মান্দা উপজেলা সদর হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে পাকুড়িয়া গ্রামে ২৮ আগস্ট সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে জনসভার নাম করে স্থানীয় পুরুষ গ্রামবাসীকে একে একে ডেকে নিয়ে আসে বর্তমান পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।
এরপর সেখানে সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সময় গায়ে রক্ত মেখে নিঃশ্বাস চেপে মৃত্যুর ভান করে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান ১৯ জন। পরে কয়েক দিনের ব্যবধানে আহতদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন শহিদ হন মুক্তিকামী ১২৮ জন মানুষ।
ছিরামিসি গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ছিরামিসি গ্রামে এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাত-আটটি নৌকা যোগে ছিরামিসি বাজারে আসে। স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার গ্রামবাসীদের খবর দেয় ছিরামিসি হাইস্কুল মাঠে শান্তি কমিটির সভা আহ্বান করা হয়েছে। গ্রামবাসীরা সেদিন স্কুল মাঠে সমবেত হয়। যারা আসতে দেরি করেন তাদেরও রাজাকারদের দিয়ে ডেকে আনা হয়। পরে পাকসেনারা ১০-১২ জন করে ছিরামিসি বিদ্যালয়ের কাছে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে লাইন ধরিয়ে গুলি করে ১২৬ জন লোককে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, যুবক, সাধারণ গ্রামবাসী ও আশ্রয় নিতে আসা স্বজনরা ছিল। ঘটনার চার-পাঁচ দিন পর কয়েকজন লোক গ্রামে ফিরে লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করে।
হত্যাযজ্ঞের পর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। ছিরামিসি বাজারের ২৫০টি দোকানে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে পাকিস্তানি হানাদাররা। সেখান থেকে হানাদাররা জনশূন্য গ্রামে লুটতরাজ চালায় ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ সালে ৩১ আগস্ট। দিনের শুরুটা অবশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। এদিন শিবপুর থানায় সফল আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। পুটিয়রের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বিক্রমে ৩৩টি মরদেহ ফেলে রেখে পালাতে হয় পাকিস্তানি হায়েনারদের। চার ঘণ্টার গুলিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন সেলিমও প্রাণ হারায়। এরপরই পাকিস্তানি হায়েনারা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর গণহত্যা চালায়।
শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলায় ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এদিন ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তার ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ওপর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি হায়েনা এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলারা সেতুটির ৬০ ফুট লম্বা স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তার পরদিন রাতে ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে বারুনিয়া এবং ভবেরচর সেতু দুটিও বিস্ফোরক লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা চালায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; যার ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি, আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাদের সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান চির জাগ্রত থাকুক।
সূত্র : গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র।
গণমাধ্যমকর্মী