কাজী সালমা সুলতানা
গতকালের পর
ঘাঘটপাড়ের গণহত্যা : ১৪ মে রংপুর শহরের ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ ও আশপাশ এলাকায় বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় পাকহানাদার বাহিনী। সেদিন শহীদদের সবার পরনে ছিল খাকি পোশাক। শহীদরা সবাই ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। পাকসেনারা ঘাঘটপাড় গণহত্যায় ৫০ থেকে ৬০ জনকে হত্যা করে।
বাড়িয়া গণহত্যা: ১৪ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বর্তমান গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া গ্রামে নিরস্ত্র বাঙালি হিন্দুদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় বাড়িয়া এবং নিকটবর্তী কামারিয়ায় প্রায় ২০০ বাঙালি হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং পাক-সেনাদের গুলিতে কয়েকশত মানুষ আহত হয়। ১৪ মে দুুপুর ১টার দিকে স্থানীয় সহযোগীরা আউয়াল, হাকিম উদ্দিন এবং মজিদ মিয়া সেনানিবাস থেকে ভাওয়াল এস্টেটে বাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০০ পাকিস্তানি সেনার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামে নিয়ে আসে। গ্রামে ঢুকার পর পরে সেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে বাড়িয়া ও কামারিয়ার প্রায় ২০০ গ্রামবাসী মারা যায় ও কয়েকশ মানুষ আহত হয়।
ইতনা গণহত্যা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ইতনা স্কুলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলে ও সেখানে স্থানীয় যুবকরা সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধীরা ইতনা স্কুলে স্থাপিত প্রশিক্ষণকেন্দ্রের খবর পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দেয়। একাত্তরের ১৫ মে প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতনা গ্রামে অভিযান চালায়। বিশেষ করে গ্রামের বিভিন্ন হিন্দু বাড়িগুলো খুঁজে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা গ্রামের গুণীজন সুশীল সেনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় তারা ওই বাড়ির অতুল পালকে খড়ের গাদার মধ্যে নিক্ষেপ করে অগ্নিসংযোগ করে। সেদিন ইতনা গ্রামের ৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে তারা হত্যা করে।
রমানাথপুর গণহত্যা : ১৬ মে পাকসেনারা খবর পায় ঝালকাঠির রমানাথপুরের মসজিদের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ট্রেনিং দেয়া হচ্ছিল ক্লাব ঘরের মসজিদের সামনে। পাকসেনাদের তারা ৫০-৬০ জন ভুল করে শরিফবাড়ি মসজিদে মুসল্লিদের ঘেরা করে এবং মসজিদ থেকে নিরীহ মুসল্লিদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন রমানাথপুরের ৩ হাজার বাসিন্দা ও শরণার্থী ওপর তিনবার গণহত্যা নির্যাতন চালায়। ঝালকাঠি জেলার ২৪টি বধ্যভূমি, ৩টি গণকবর পাওয়া যায়, যেখানে পাকসেনারা গণহত্যায় নিহত মানুষদের হত্যা করে ফেলে যায়।
যুগীশো ও পালশা গণহত্যা : ১৬ মে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন রাজশাহীর যুগীশো ও পালশা গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার কর্তৃক বাঙালি হিন্দুদের ওপর চালিত পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এদিন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ৪২ জন বাঙালি হিন্দুকে হত্যা ও বাড়িঘর লুটপাট করে।
কাঠিপাড়া গণহত্যা: ১৭ মে পাকহানাদাররা ঝালকাঠির রাজাপুরের কাঠিপাড়ায় আসে। নৈকাঠি ইউনিয়নের সাতুরিয়া গ্রামের চেয়ারম্যান হামেদ জমাদার ও তার দুই ছেলে বেলায়েত জমাদার ও মিল্লাত জমাদ্দার এ সময় হানাদারদের খবর দিলে হানাদাররা জঙ্গল ঘেরাও করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পুরুষদের হত্যা করে। এরপর তারা এলাকার নারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। সেদিন শহিদ হন প্রায় অর্ধশত মানুষ।
শিবচর গণহত্যা : ১৭ মে বেলা ১১টার দিকে ৪০-৪২ জনের পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মাদারীপুর ক্যাম্প থেকে লঞ্চে করে শিবচরের উৎরাইলে আসে। তারা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদাররা শিবচরের চর শ্যামাইল হয়ে গুলালতা, বাহেরচর, উমেদপুর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় ও নারীদের ধর্ষণ ও শতাধিক বাড়িতে লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই গণহত্যায় ২০ জনের বেশি মানুষ শহিদ হন।
জলাপুকুরপাড় গণহত্যা: দিনাজপুর জেলায় এ পর্যন্ত সাতটি গণহত্যার খোঁজ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুজালপুর ইউনিয়নের জলাপুকুরপাড় গণহত্যা অন্যতম। ১৭ মে সকালে স্থানীয় কিছু বিহারি শুজালপুর ইউনিয়নের সাহাপাড়া গ্রাম থেকে ১০ জনকে গাড়িতে করে জলা পুকুরপাড়ে নিয়ে যায় ও সেখানে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে জীবন বাঁচাতে গ্রামের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যান। পরে বর্ষা গ্রামের ৩ জন লোক এসে জলাপুকুর পাড়েই লাশগুলোকে মাটি চাপা দেন।
জিন্দাপীর গণহত্যা : ১৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সাত্যের ইউনিয়নের আরাজি চৌপুকুরিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। এটাই জিন্দাপীর গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকসেনারা সেদিন গুলি করে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তারা গ্রামের নারীদের নির্যাতন করে ও গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ কাজে সহায়তা করে তাদের দোসর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।
চুকনগর গণহত্যা: ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ঘটে ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা। এদিন বেলা ১১টার দিকে পাক মিলিটারির বাহিনীর দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপ গাড়িতে এসে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই-তিনটি গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকে মুখঢাকা কিছু লোকজনও আসে।
স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালির (বিহারি) সহায়তায় তারা হত্যা শুরু করে। ওইদিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও অনেক নারী ও শিশুকে হত্যা করে বর্বর পাকবাহিনী। সেদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হন। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই নদীতে ডুবে মারা যান।
পিরোজপুর গণহত্যা: ৩ মে, বরিশাল শহর থেকে গানবোটসহ ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে কর্নেল আতিক পিরোজপুরের হুলারহাট আসেন। এসেই তিনি গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেন। পিরোজপুর শহরতলির মাছিমপুরের মন্ডলপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়ায় এদিন ৬২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা। স্থানীয় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সহযোগিতায় পাকসেনারা শহরের খুমুরিয়া শিকদার বাড়ির ১২টি, মুক্তারকাঠীর ৬টি, বসন্তপুল এলাকায় ১১টিসহ শতাধিক ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে।
সাতানিখিল গণহত্যা: ১৩ মে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার কেওয়ার ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় হানাদাররা। এরপর ১৪ মে কেওয়ার সাতানিখিল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে গিয়ে তাদের ১৬ জনকে চোখ বেঁধে হত্যা করে। গণহত্যার দু’দিন পর ১৬ মে পাকিস্তানি হানাদাররা এসে ১৪টি লাশ পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দেয়। (চলবে)
গণমাধ্যমকর্মী