Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 8:59 am

বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েশন অর্জন এবং পরবর্তী চ্যালেঞ্জসমূহ

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারির প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশ ভালোই রয়েছে। করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিডের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে দ্রুতহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ২০২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছিল, তবে পরের বছরই অর্থাৎ ২০২১ অর্থবছরে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হয় এবং ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা তুলনামূলক উন্নয়নশীল অর্থনীতির তুলনায় যথেষ্ট ভালো। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ সবকিছুর জন্য আমাদের কৃষকের পাশাপাশি শিল্প উৎপাদন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ৫০ বছরের যাত্রা অসাধারণ এবং অনেকের কাছে এটি একটি ‘অসম্ভব অর্জনের দেশ’। বাংলাদেশের প্রভাবশালী আখ্যানটি একটি অর্থনৈতিক অলৌকিক ঘটনা। দেশগুলোর চিত্তাকর্ষক স্কোর কার্ড নির্মিত হয় তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসহ (এমডিজি) বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স দ্বারা।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাফল্য বাংলাদেশকে দ্বৈত গ্র্যাজুয়েশন এনে দিয়েছেÑনি¤œ-আয়ের দেশ থেকে নি¤œ মধ্য-আয়ের দেশে এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) গ্রুপ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে গ্র্যাজুয়েশনের যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০২৬ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে গ্র্যাজুয়েট করানোর জন্য রেজুলেশন গৃহীত  হয়েছে। এটি বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় একটি যুগান্তকারী অর্জন।

এলডিসি গ্রুপ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের অর্থ হচ্ছে উন্নয়ন অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী অনুমোদনের সিলমোহর অর্জন করা, যা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। বাংলাদেশের সুবিবেচনাপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পিত বিনিয়োগের ফলে উন্নয়নশীল দেশের গ্রুপে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সামর্থ্য অর্জিত হয়েছে। যাহোক, বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ যাতে না হয় এবং সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, সেদিকে সরকারের যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা স্নাতকোত্তর কিছু চ্যালেঞ্জের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ যদি এই পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়, তবে এ রূপান্তরের পথে গুরুতর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। 

যেহেতু গ্র্যাজুয়েশনের ফলে বাংলাদেশ কিছু অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে প্রভাবিত করবে, তাই বাংলাদেশকে এই পরিবর্তনকে টেকসই করতে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। প্রতিটি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে সবচেয়ে সাধারণ যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তা হলো এলডিসি-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবস্থার ক্ষতি। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা এবং পছন্দের পতন বাংলাদেশের রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ দেশটি আরএমজি খাতের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে, যা কয়েক দশক ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি নিয়ে আসছে।

এ পরিণতিগুলো এড়াতে ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, হস্তশিল্প, কৃষিজাত পণ্য, মাছ, হিমায়িত খাবার প্রভৃতির মতো নতুন পণ্য রপ্তানির প্রচারের মাধ্যমে দেশের রপ্তানির ঝুড়িকে বৈচিত্র্যময় করতে হবে। এছাড়া সরকারকে বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও সুদূর পূর্ব অঞ্চলের বাজারকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং রপ্তানি গন্তব্যে বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্যে এ বাজারগুলোয় অনুপ্রবেশের জন্য কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশেরও বিভিন্ন আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্লকে যোগদান করতে হবে এবং সম্ভাব্য পৃথক দেশের সঙ্গে এফটিএ সই করতে হবে, যা কিনা বাণিজ্য ভারসাম্যের ওপর স্নাতকের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে।

প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য এবং ২০২৬ সালের পরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশের উচিত জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করা, বিদেশি ও স্থানীয় উভয় সম্পদ একত্রিত করা, ব্যবসা করা সহজীকরণসহ অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করা, উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদনের দিকে যাওয়া, গুরুত্ব-সহকারে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রচার করা, একই প্রণোদনা অন্যান্য শিল্পকে দেয়া, যা আরএমজি’কে প্রদান করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংযোগ বৃদ্ধি করাও দরকার। বাংলাদেশকে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে পরিণত করার পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ তা পারবে, ইনশাআল্লাহ।

আইসিসিবির ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়