নূরে এ. খান: বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় মানবসম্পদের প্রাচুর্য বেশি। এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এ দেশের মানুষ। যদি এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুততর হবে। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের প্রসার ঘটিয়ে কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা গেলে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, অপরাধ প্রবণতা হ্রাস এবং সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এ প্রবন্ধে আমরা মানবসম্পদের গুরুত্ব, কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপায়, শিল্প খাতের বিকাশ এবং সরকারের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মানবসম্পদের গুরুত্ব: একটি দেশের উন্নয়নের জন্য মূলশক্তি তার জনসংখ্যা। যদি এই জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবসম্পদকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে মানবসম্পদই প্রধান শক্তি। দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে একটি দেশ তার প্রকৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে না। তাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা এবং তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের গুরুত্ব: বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধশিল্প, চামড়াশিল্প ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ব্যাপক। এই শিল্পগুলোয় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প: বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাকশিল্প। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতে কাজ করছে এবং এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এই খাতের আরও সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন করা গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং: বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ফ্রিল্যান্সিং খাতে সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিনির্ভর কাজের চাহিদা বাড়ছে, তাই এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করে দেশকে আরও এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
ওষুধ ও চামড়াশিল্প: বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে সুনাম অর্জন করেছে। যদি সরকার এ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে এবং আধুনিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে, তাহলে এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে চামড়াশিল্পকেও আধুনিক প্রযুক্তি ও মানসম্পন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠী এখনও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা সম্ভব।
কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার উপায়: সরকার যদি পরিকল্পিতভাবে শিল্প উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উদ্যোগ নেয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এজন্য কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে—
১. শিল্প কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি: নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
২. কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. নতুন খাতের উন্নয়ন: শুধু পোশাক খাত নয়, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, চামড়া ও কৃষিভিত্তিক শিল্পেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
৪. উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও স্টার্টআপ উন্নয়ন: তরুণদের জন্য সহজ ঋণ, ব্যবসা শুরুর জন্য সরকারি সহায়তা এবং নতুন বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা: ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারকে অনুকূল নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা সহজেই নতুন উদ্যোগ নিতে পারেন।
সমাজ থেকে অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপ দূর করার উপায় বেকারত্ব একটি বড় সামাজিক সমস্যা। বেকার যুবসমাজ কর্মসংস্থানের অভাবে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই কর্মসংস্থান বাঙালে অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি: দক্ষতা না থাকায় অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলেও কাজে যোগ দিতে পারেন না। তাই দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ বাঙাতে হবে।
মাদক ও অপরাধ প্রতিরোধে কর্মসূচি গ্রহণ: কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে যুবসমাজ মাদক, ছিনতাই, সন্ত্রাস প্রভৃতি থেকে দূরে থাকবে।
নারী শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো: নারীদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে পরিবার ও সমাজ আরও সুসংহত হবে।
উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা বৃদ্ধি: বেকারত্ব কমাতে হলে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে এবং সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
সরকারের করণীয় বর্তমান সরকার যদি দ্রুততম সময়ে মানবসম্পদের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে দেশ আরও উন্নত হবে। সরকারের করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—
১. শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ: নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা ও বেসরকারি খাতকে সহায়তা করতে হবে।
২. মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ: শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।
৩. বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি: দক্ষ জনশক্তিকে বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যেতে পারে।
৪. প্রশাসনিক সংস্কার ও নীতি সহায়তা: ব্যবসা ও শিল্প উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানবসম্পদ। যদি এই সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতি বহুগুণে সমৃদ্ধ হবে। শিল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো গেলে সমাজ থেকে অপরাধ কমবে, দারিদ্র্য দূর হবে এবং দেশ আরও উন্নত হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, উদ্যোক্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তাহলেই আমরা এক উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব।
সিইও, চার্ম