বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং: অগ্রগতি চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

 . মো. গোলজারে নবী: বর্তমান বিশ্বে ইসলামিক ফাইন্যান্স মুসলিম ও অমুসলিম প্রধান উভয় দেশগুলোতেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রাথমিক অবস্থায় ১৯৬০ ও ১৯৮০ দশকে ইসলামিক ফাইন্যান্স রিটেইল ব্যাংকিং সেবা প্রদান করলেও বর্তমানে মূলধন বাজার এবং বিমাসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করছে। ইসলামিক ফাইন্যান্সের প্রধান অংশ ইসলামিক ব্যাংক সমাজের শিল্পপতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা শ্রেণির জন্য বিভিন্ন বাণিজ্যিক মুনাফানির্ভর হাতিয়ারগুলোর মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে। তবে ইসলামিক ফাইন্যান্সের  অন্যতম অংশ মূলধন বাজার এবং বিমা খাত ইসলামিক ব্যাংকের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এছাড়া সমাজের দরিদ্র এবং বঞ্চিত মানুষদের অসুবিধা দূরীকরণের জন্য অতীব কার্যকর ইসলামিক ফাইন্যান্সের অবশিষ্ট অংশ সামাজিক অর্থায়ন তথা জাকাত, ওয়াকফ্ এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে সীমিত পর্যায়ে সেবা প্রদান করছে। বাংলাদেশসহ ওয়াইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামিক ফাইন্যান্স দ্রুত প্রসার লাভ করছে। ইরান ও সুদান তাদের আর্থিক খাতে শতভাগ ইসলামিক ব্যাংকিং চালু করতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী  শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছেÑমালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, ইউএএ, বাহরাইন, কুয়েত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক। অমুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল, সিঙ্গাপুর, চীন, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশগুলোয় ইসলামিক ব্যাংকিং ও মূলধন বাজারের প্রবল উপস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইসলামী ব্যাংকিং না থাকলেও বোম্বে স্টক একচেঞ্জে শরিয়াহ সূচক এবং বিভিন্ন রাজ্যে শরিয়াহভিত্তিক সমবায় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু আছে।

বাংলাদেশে ইসলামিক ফাইন্যান্সের প্রধান অংশ ইসলামিক ব্যাংক সফলভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালে চালু হলেও ১৯৯০ দশক থেকে বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং খাতের প্রসার ঘটছে এবং বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট আমানত, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশের অংশীদার। তবে ইসলামিক ফাইন্যান্সের অন্যান্য অংশ তথা মূলধন বাজার, বিমা খাত এবং সামাজিক অর্থায়ন তথা জাকাত, ওয়াকফ্ এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ইতিহাসিক পটভূমি :

ইতিহাসে দেখা যায়, ৭০০-১৩০০ সময়কালে ইসলামের ইতিহাসের সোনালি মধ্যযুগে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেনে সুদমুক্ত ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক হাতিয়ারগুলোর বহুল ব্যবহার ছিল। এ সোনালি যুগে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক হাতিয়ারগুলোর আইনি কাঠামো উন্নয়নে ইমাম আবু ইউসুফ (র.), ইমাম শাইবানি (র.), ইমাম গাজ্জালি (র.), ইমাম তাইমিয়া (র.) এবং অন্য স্কলারগণ অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। এ সময়কালে ইসলামিক দিনার ও দিরহাম আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। ১৪শ’ শতকে ইবনে খালদুন অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন; যার কারণে এডাম স্মিতের বদলে তাকে অর্থনীতির জনক হিসেবে অনেকে অভিহিত করে থাকেন।

পরবর্তী সময়কালে অধিকাংশ মুসলিম দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর শাসন শুরু হলে সুকুকসহ অন্যান্য ইসলামি আর্থিক ও বাণিজ্যিক অর্থায়নের হাতিয়ারগুলোর ব্যবহার ধীরে ধীরে হ্রাস বা বিলুপ্ত হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন শুরু করলে মুসলিম মহান চিন্তাবিদরা ইসলামি শরিয়াহ্ সম্মত আর্থিক ও বাণিজ্যিক অর্থায়নের হাতিয়ারগুলোর ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

১৯৬৩ সালে মিসরে প্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলো সৌদি আরবের জেদ্দা নগরীতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলে দেশে দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জোয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯০-এর দশকে সুদ ভিত্তিক বন্ডের বিকল্প হিসেবে ইসলামি শরিয়াহ্র আলোকে মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন, বাজেট ঘাটতি পূরণ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে সুকুকসহ শরিয়াহভিত্তিক হাতিয়ারসমূহের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে এগুলো মুসলিম ও অমুসলিম প্রধান উভয় দেশগুলোতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যপদ লাভ করে। আইডিবি সদস্য দেশগুলো এর চার্টারে স্বাক্ষর করে তাদের ব্যাংকব্যবস্থা  ইসলামি শরিয়ার আলোকে পুনর্গঠনের অঙ্গীকার করে। এ অঙ্গীকার ও মুসলিম জনগণের চাহিদার আলোকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭০ দশকে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ঢাকাস্থ ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরো সভা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজনের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা দল গঠন করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে দেশীয় উদ্যোক্তাগণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দাতব্য সংস্থা ও ব্যবসায়ীবৃন্দের ইক্যুইটি সহায়তায় ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যার মাধ্যমে এদেশে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্ব প্রথম ইসলামী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো:

ক. প্রচলিত সুদি ব্যাংকের তুলনায় হ্রাসকৃত সংবিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের হার (এসএলআর); খ. ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ ইসলামী ব্যাংক সংক্রান্ত ধারা সংযোজন; গ. ইসলামী ব্যাংকি গাইডলাইন ২০০৯ ইস্যু; ঘ. আইসিসি গাইডলাইন ২০১৬-এ শরিয়াহ অডিট-সংক্রান্ত পৃথক চ্যাপ্টার (৮ম) অন্তর্ভুক্তকরণ; ঙ. বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগে ইসলামি ব্যাংকিং উইং প্রতিষ্ঠা; চ. ইসলামি ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের জন্য পৃথক ২টি বিভাগ সৃষ্টি; ছ.  বিআরপিডি ও ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে ইসলামী ব্যাংক ও সিকিউরিটিজের জন্য পৃথক উপবিভাগ গঠন, জ. বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে শরিয়াহ উপদেষ্টা এবং টেকনিক্যাল কমিটি গঠন; ঝ. ইসলামি ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ইসলামি বিনিয়োগ বন্ড এবং সুকুক ইস্যুর ব্যবস্থাকরণ; ঞ. এসএমই খাতে পুনঅর্থায়নের জন্য ইসলামি ব্যাংকগুলোর  জন্য পৃথক কর্মসূচি প্রণয়ন; ট. বাংলাদেশ ব্যাংকের ওঋঝই-এর সদস্যপদ গ্রহণ; ঠ. কভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজে ইসলামি ব্যাংকগুলোর অন্তর্ভুক্তি।