বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ৪০ বছর

রেজাউল করিম খোকন: যারা জাহান্নামের আগুনকে ভয় পায়, তারা সুদমুক্ত মনে করেই ইসলামি ব্যাংকিং বেছে নেন। বেশি মুনাফা বা লাভের আশা তারা করেন না। তবে ইসলামি ব্যাংক গ্রাহকদের কখনও ঠকায় না। যে কারণে একবার কোনো  গ্রাহক ইসলামি ব্যাংকে এলে অন্য ব্যাংকে যান না। ইসলামি ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি কম হয়। আমানত হারানোর ভয়ও নেই। এছাড়া ব্যাংকটি শতভাগ সুদমুক্ত। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত সুদ হারের কাছাকাছি বা তার চেয়েও কম মুনাফা এলেও চূড়ান্ত হার নির্ধারণ করে দেয় না। তবে বছর শেষে বা মেয়াদ শেষে ঠিকই গ্রাহকদের অন্য যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দেয়। এ কারণে ব্যাংকটিতে আমানতকারী বেড়েছে। এখন ব্যাংকটিতে এক কোটি ৬৬ লাখেরও বেশি আমানতকারী রয়েছেন। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পথচলা শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৩ মার্চ ১৯৮৩ সালে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামি ব্যাংকরূপে এ ব্যাংকটি নিবন্ধিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পায় ২৭ মার্চ ১৯৮৩। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় মূলত ১২ আগস্ট ১৯৮৩ থেকে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। সম্মেলনে মুসলিম দেশগুলোয় আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরেই ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আইডিবি সনদ স্বাক্ষর করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স প্রদান করে। পূবালী ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম খালেদ, সোনালী ব্যাংকের স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল এম আযীযুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর নূরুল ইসলাম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আব্দুর রাজ্জাক লস্কর, তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ খালিদ খান, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফের পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল জব্বার ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুছসহ কিছুসংখ্যক উদ্যোগী ব্যক্তিত্ব, চারটি প্রতিষ্ঠান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দু’জন বিদেশি ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক শুধু দেশে নয়; দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দেশের মোট আমানতের ২৭.৫৪ শতাংশ ইসলামি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে। মোট ব্যাংকিং খাতের ২৫ শতাংশ এবং এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের। ইসলামী ব্যাংক প্রায় ২ কোটি গ্রাহকের আস্থার ব্যাংক। সারাদেশে প্রায় ৬ হাজার ইউনিটের মাধ্যমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ আমানত নিয়ে ইসলামী ব্যাংক দেশের শীর্ষ ব্যাংক। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণের মাধ্যমে এ ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে রাখছে গতিশীল। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক আহরণ করেছে ৪৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। এ ব্যাংক ডিসেম্বরে রেকর্ড ৫০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করেছে, যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক ব্যাংক। গত বছর রপ্তানি খাতে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে অর্জিত হয় ৪০৩ কোটি মার্কিন ডলার। জাতীয় অগ্রাধিকারভুক্ত খাতসহ সার আমদানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে এ ব্যাংক। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৭৩ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সার আমদানি হয়েছে, যা দেশের বেসরকারি খাতে আমদানির ৬৫ শতাংশ। ফলে এগিয়ে কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতার মাধ্যমে দেশ চলছে সমৃদ্ধির পথে। ভারী ও হালকা সব ধরনের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে এ ব্যাংক সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে। ফলে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা, সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ এসএমই বিনিয়োগকারী ব্যাংক। এ ব্যাংকের অর্থায়নে ৬ হাজারের বেশি শিল্পকারখানা পরিচালিত হচ্ছে। এ ব্যাংকের বিনিয়োগে দেশে ৪ লাখ পরিবার আবাসন লাভ করেছে। জাহাজ নির্মাণসহ দেশের আকাশ, স্থল এবং নৌ পরিবহন খাতে ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নে ৩০ হাজার গ্রামের ১৫ লক্ষাধিক প্রান্তিক পরিবারের মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করেছে এ ব্যাংক, যার সদস্যদের ৯৪ শতাংশই নারী। ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ কর প্রদানকারী দেশীয় ব্যাংক। এক যুগ ধরে বিশ্বসেরা ১ হাজার ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। সম্প্রতি এ ব্যাংক বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার ‘সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামিক রিটেইল ব্যাংক’ এবং বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এভাবেই আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ইসলামী ব্যাংক দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা।

এছাড়া প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় ইসলামি অর্থায়নে বিনিয়োগে মূলধনে মুনাফার হার বেশি এবং খেলাপির ঋণের পরিমাণ তুলনামূলক ইসলামি ব্যাংকিংয়ে কম। সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংকিং র‌্যাংকিংয়ে ১১তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বিশ্বের ১০০০ সেরা ব্যাংকের একটি। বাংলাদেশের ইসলামি অর্থায়ন, সামগ্রিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমে গোটা বিশ্বের কাছে এটি একটি রোল মডেল। বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের ৩৫ শতাংশ গ্রাহক এবং বৈশ্বিক ক্ষুদ্র ঋণের ৫০ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বের ইসলামি অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য অংশীদার। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অব্যাহত সাফল্য ও অগ্রগতি দেখে দুই দশকের পুরোনো ব্যাংকও প্রচলিত ব্যাংকিং ছেড়ে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু করেছে। চাহিদা তৈরি হওয়ায় দেশের ৬১টি ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩৪টি বিভিন্নভাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী আয়ের ৩৩ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। গতানুগতিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা দ্রুত বড় হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মোট ১০ হাজার ৭৬৭টি ব্যাংক শাখার মধ্যে এক হাজার ৭৫৫টি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শাখা রয়েছে। ব্যাংকিংয়ের শাখা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনবল রয়েছে ৪৩ হাজার ২৮৮ জন। ইসলামি ব্যাংকগুলো শাখা কার্যক্রমের পাশাপাশি এজেন্ট ও উপ শাখার মাধ্যমেও বিস্তৃতি লাভ করছে। এছাড়া এটিএম, সিআরএম-সহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়েও ইসলামি ব্যাংকগুলো এগিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পথ ধরে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-বারাফা ব্যাংক, যা বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর পর ১৯৯৫ সালে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং ধারা ছেড়ে ২০০৪ সালে ১ জুলাই ইসলামি ব্যাংকিংয়ে আসে এক্সিম ব্যাংক। ২০০৯ সালে ১ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক সুদভিত্তিক ব্যাংক পরিহার করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নাম ধারণ করে। এরপরে ২০১৩ সালে আসে ইউনিয়ন ব্যাংক। ২০২১ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। তা ছাড়া বহুজাতিক এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডও ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১০টি ব্যাংক ‘পূর্ণাঙ্গরূপে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং’ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হলোÑ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক (এক্সিম) লিমিটেড, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড। এর পাশাপাশি এ বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে পুরোপুরি ইসলামি ধারার ব্যাংক হওয়ার অনুমতি পেয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা খুলেছে আরও বেশ কিছু ব্যাংক। সেগুলো হলোÑসোনালী ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, এবি ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও যমুনা ব্যাংক লিমিটেড। সর্বশেষ এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড।

ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই মুরাবাহা পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। মোট বিনিয়োগের ৪৫ শতাংশ রয়েছে এই পদ্ধতিতে। এর বাইরে রয়েছে বাই মুয়াজ্জাল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ১৪.৫৮ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া বাই সালাম ইজারা, বাই ইসতিসনা, মুশারাকাসহ অন্যান্য পদ্ধতিও রয়েছে। ক্ষুদ্র মাঝারি খাত, আবাসিক খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ কৃষি খাতে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় আমানত সংগ্রহে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটির বর্তমান আমানতের পরিমাণ এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট আমানতের ১০ ভাগেরও বেশি। ব্যাংকটির বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংকিং ঋণ বা বিনিয়োগের ৯ শতাংশ। আমানত ও বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সর্বোচ্চ চূড়ায়। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যেও শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। আমদানি-রপ্তানি খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবদান উল্লেখযোগ্য। দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, কলকারখানা, শিল্পায়নেও ইসলামী ব্যাংক অবদান রেখে যাচ্ছে। চার দশকে উপনীত এ ব্যাংকটি ছয় হাজারেরও বেশি শিল্পকারখানায় অর্থায়ন করেছে। গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, স্পিনিং মিল, স্টিল রি-রোলিং, লোহা ও ইস্পাত শিল্প, বিদ্যুৎসহ নানাবিধ ভারী শিল্পকারখানায় ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের প্রায় এক হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট শিল্প পরিচালিত হচ্ছে এই ব্যাংকের অর্থায়নে। কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পাটশিল্প, চামড়াশিল্পেও এ ব্যাংকের বড় ধরনের অবদান বিনিয়োগ রয়েছে। সড়ক পরিবহন, বিমান, নৌপথেও ইসলামী ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রায় পাঁচ শতাধিক শাখা ও উপশাখা রয়েছে। ২৭০০ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে। বর্তমানে এক কোটি ৬০ লাখ গ্রাহককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রায় ২০ হাজার জনশক্তি। পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রমেও ব্যাংকটি বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেশের ২৮ হাজার ৯২১টি গ্রামে পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম (আরডিএস) সম্প্রসারণ করেছে। যেখানে গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, যার ৯২ শতাংশই নারী।

চার দশকের পদার্পণে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের শরিয়াহ পরিপালন ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে কতটুকু অবদান রাখছে তা মূল্যায়ন করা উচিত। এখনও দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। তাদের ইসলামি ব্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। ব্যাংকার ও গবেষকদের মতে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থার ওপর শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। ইসলামি ব্যাংকিং অর্থায়নে পদ্ধতি ও লেনদেনে শরিয়াহ পরিপালনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও কর্মকর্তার এখনও ঘাটতি রয়েছে।

ইসলামি ব্যাংকিং চার দশকে পদার্পণ করলেও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরিপূর্ণ বিকাশে পৃথক পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকিং আইন এখনও করা যায়নি। গ্রাহক পর্যায়ে মুদারাবা আমানতকারী ও বিনিয়োগ গ্রহীতা উভয়েরই ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালার মৌলিক বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। দেশের বিশিষ্টজনের মতে, ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সফলতা ও অগ্রগতিকে সামনে রেখে গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পরিপূর্ণ ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা উচিত। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি হলো শরিয়াহ পরিপালন ও সুদমুক্তভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা। ইসলামি ব্যাংকগুলো আগামীতেও গ্রাহকের আস্থা ও ভালোবাসা নিয়ে জনগণকে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাবে।   

নতুন করে আরও দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে ইসলামি নীতিমালা অনুযায়ী অনুমোদন দেয়া দেশে এখন ইসলামি ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি। বেসরকারি খাতের দুটি ব্যাংককে ১ ডিসেম্বর থেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারার সেবা চালু করার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে একটি ব্যাংক আগের নামেই কার্যক্রম পরিচালনা করবে, অন্য একটি নাম পরিবর্তন করে পরিচালিত হবে। ব্যাংক দুটি হলো স্ট্যান্ডার্ড ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পয়লা জানুয়ারি থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তর করা হলো। আর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ করা হয়েছে। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ছিল প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত একটি ব্যাংক। এখন থেকে এনআরবি নামটি ব্যাংকটি থেকে বাদ পড়ছে। ১৯৯৯ সালের ৩ জুন দ্বিতীয় প্রজšে§র ব্যাংক হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। সারাদেশে ব্যাংকটির রয়েছে ১৩৮টি শাখা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রায় ৭ লাখ গ্রাহক। এছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়ে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ব্যাংকটির দেশব্যাপী ৬৯টি শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ইসলামি ব্যাংকিং এর আগে ছিল ৮টি ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছেÑ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, এক্সিম ব্যাংক (বাংলাদেশ), ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। নতুন দুটি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড ও গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডসহ ১০টি ব্যাংক।

১৯৮৩ সালে দেশে প্রথম চালু হয় ইসলামি ব্যাংকিং। এখন এ ধরনের ব্যাংক আছে ১০টি। দেশের ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে আছে আলোচনা-সমালোচনা ও জিজ্ঞাসা। প্রচলিত ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো সচরাচর তার চেয়ে বেশি মুনাফা দেয় না। তবু আমানতকারীরা ঝুঁকছে ইসলামি ব্যাংকগুলোর দিকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুধু তা-ই নয়, কভিডের কারণে ব্যাংক খাতে যখন টাকার সংকট, তখন প্রথম ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি আমানতের হিসাবে শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই ইসলামি ধারার ব্যাংক। বেসরকারি খাতের তৃতীয় ও চতুর্থ সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে যথাক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক (বাংলাদেশ)। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের আমানত প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বলছে, কভিডকালের দুই বছরেই ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালের শুরুতে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। জানা গেছে, বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা ৬০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। দেশি-বিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদের অফার করছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। অথচ এই ব্যাংক তিনটিতে টাকা রাখার প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ নেই। একইভাবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাসের কম সময়ের আমানতে সুদ দিচ্ছে ৭ শতাংশ হারে। অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক আমানতের বিপরীতে সম্ভাব্য মুনাফা ঘোষণা করেছে ৬ শতাংশেরও নিচে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের অন্য কোনো ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ধারেকাছেও নেই। সারাদেশে ৩৮৪টি শাখা, ২১৯টি উপশাখা, ২ হাজার ৬৭৮ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও  ২ হাজার ৩১৮টি এটিএম ও সিআরএম বুথ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের।

ইসলামী ব্যাংকের মূল সম্পদ হলো গ্রাহক। গ্রাহকদের ভালোবাসায় ইসলামী ব্যাংক আজ এ পর্যায়ে। তারাই ইসলামী ব্যাংকের অ্যাম্বাসেডর। সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা নিজেদের সর্বোচ্চটুকুই দিয়ে থাকেন। কর্মীদের সততা, আত্মোৎসর্গের মানসিকতা ও পেশাদারিত্ব এ ব্যাংককে দেশের মানুষের হƒদয়ে জায়গা করে দিতে সহযোগিতা করেছে। মুসলমান প্রধান দেশ হওয়ায় ছোট আমানতকারীরা তাদের টাকা রাখার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংককেই প্রথমে বেছে নেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা আরও মনে করেন, যেসব গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকে গেছেন বা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই সুদকে হারাম মনে করেন বলেই গেছেন। অবশ্য মানুষ এখন লাভের চেয়ে আমানত খোয়ানো নিয়ে বেশি চিন্তিত। ফলে বেশি সুদে কেউ পদ্মা ব্যাংকে আমানত রেখে বিপদে পড়তে চান না। মানুষ এখন ভালো প্রতিষ্ঠান বাছাই করে সেখানে আমানত রাখছেন। কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণ ও ছোট গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখছেন। সাধারণ মানুষ ব্যাংকটিতে টাকা রাখতে উৎসাহ বোধ করার অন্যতম কারণ, ব্যাংকটিতে বড় কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।

শুধু গ্রাহকরাই নয়, বেশ কিছু প্রচলিত ধারার ব্যাংকও ইসলামি বিভাগ ও স্কিম চালু করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে অন্তত সাড়ে ৫ হাজার শাখা-উপশাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালিত হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ৩৩টি ব্যাংক কোনো না কোনোভাবে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে পুরোপুরি ইসলামি ধারায় আছে ১০টি। ব্যাংকগুলো হলোÑইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক। আরও ৯টি ব্যাংক তাদের ৪০টি শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। এর বাইরেও ১৪টি ব্যাংক তাদের ১৯৪টি শাখায় ‘ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো’ খুলেছে। গত বছরের শুরু থেকে পূর্ণাঙ্গ শরীয়াহভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে এনআরবি গ্লোবাল নামের এই ব্যাংকটি। তাদের নতুন নাম হয়েছে ‘গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক’। সম্প্রতি এরকম দু’টি ব্যাংক ইসলামি ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করায় বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে ১০-এ উঠেছে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রচলিত ধারার বেশ কিছু ব্যাংকে ইসলামি ধারার ব্যাংকের একটি ‘উইন্ডো’ খোলা হয়েছে। এদের মূল পার্থক্যটা কীÑমূল পার্থক্যের জায়গাটা হচ্ছে সুদ এবং মুনাফার হিসেবের ক্ষেত্রে। মূল ধারার ব্যাংকিংয়ে সুদের বা ইন্টারেস্টের বিষয়টা থাকে। আমরা যখন ব্যাংকে টাকা জমা রাখি তখন একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়াই হচ্ছে। সেখানে ব্যাংকের লাভ বা ক্ষতি হোক আমরা যারা টাকা জমা রাখছি আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় হয় না। কিন্তু ইসলামে যেহেতু সুদকে হারাম বলা হয়ে থাকে তাই এটা অনেকের কাছে অনেকটা গ্যাম্বলিংয়ের মতো। ইসলামের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে এটা একটা শেয়ারিং মেথড হবে। ‘প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ অর্থাৎ ব্যাংক যেহেতু আমার কাছ থেকে আমানত রাখছে, ব্যাংকের যদি লাভ হয় তাহলে আমার আমানতের ওপর আমি লভ্যাংশ পেতে পারি। কিন্তু ব্যাংকের যদি ক্ষতি হয় তাহলে আমি লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য যোগ্য হব না। এটাই প্রচলিত এবং ইসলামি ধারা ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য। ইসলামি ধারার ব্যাংক পিএলএস অর্থাৎ ‘প্রফিট-লস-শেয়ারিং’ এ চলে কিন্তু ট্র্যাডিশনাল ব্যাংক বা প্রচলিত ব্যাংকে এটা একটা স্টেটেড রেট থাকে। একই ব্যবস্থা দেখা যায়, ব্যাংক থেকে ঋণের ক্ষেত্রেও। ঋণ করলে সেই টাকা আমি লাভজনকভাবে কোথাও ব্যবহার করতে পারছি কি না সেটা কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক দেখবে না। তারা একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ কেটে নেবে। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলোতে সেই ব্যবস্থা নেই। মূলধারার ব্যাংকে প্রফিট মেকিং বা মুনাফা করাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলোতে প্রফিটের বিষয়টা সেভাবে প্রাধান্য দেয়া হয় না। বিশ্বের যেসব দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা আছে তারা এভাবেই পরিচালনা করে। ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ের কয়েকটি দিক: মুদারাবা কনসেপ্ট- মুনাফার অংশীদারি, মুরাবাহা-লাভে বিক্রি (লোনের ক্ষেত্রে), মুসারাকা-লাভ লোকসানের ভাগাভাগি। আর এই লাভ লোকসানের ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ইসলামি ধারা মানা হয় না বলে মনে করেন অনেকে। দুই ধারার ব্যাংকের একটা মিল হলো তাদের কর্তৃপক্ষ বা রেগুলেটরি এক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোথাও ইসলামি কোনো উইং নেই। ইসলামি ধারা ব্যাংকে লাভ বা ক্ষতির ওপর মুনাফার অংশ হেরফের হতে পারে। আগে থেকে কোনো কিছু নির্দিষ্ট থাকবে না। কিন্তু আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকে আগে থেকেই জানা যায় রেট, যে আমানতকারী কত শতাংশ মুনাফা পাবে। বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামি ব্যাংক পরিচালনা করা হয়ে থাকে সেটা উদ্বেগের। বাংলাদেশে এগুলো যেভাবে পরিচালিত হয় সেখানে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী ধারায় পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের দেশের যারা ইসলামি চিন্তাধারায় বিশ্বাস করেন, তাদের কাছ মনে হতে পারে ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম। বেশির ভাগ মানুষের যে চিন্তাধারা সেটাতে তারা মনে করে এই টাকাটা বিনিয়োগ করা হচ্ছে এবং সেখান থেকে রিটার্ন পাচ্ছেন। অর্থাৎ তারা এটাকে গ্যাম্বলিং মনে করেন না। সেই অর্থটাকে তারা বৈধ হিসেবে মনে করে। এটাতে তাদের একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করে। এর ফলেই প্রচলিত ব্যাংকগুলো তাদের ইসলামি উইনডো ও শাখা রাখছে ইসলামী ব্যাংকের।

ইসলামি ব্যাংকিং বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ক্রমবিকাশমান ও ব্যাপক জনপ্রিয় একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ইসলামি ব্যাংকিং বলতে সহজে যে কথা বোঝা যায় সেটি হলো, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। মালয়েশিয়ার ইসলামি ব্যাংকিং অ্যাক্টে ইসলামি ব্যাংকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামি ব্যাংকিং এমন একধরনের ব্যবসা, ৬ যার লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ডের কোথাও এমন কোনো উপাদান নেই, যা ইসলাম অনুমোদন করে না।’  ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ইসলামি ব্যাংকের একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। সেটি হলো, Islami Bank is a financial institution whose statutes, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Sharia and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its operations. অর্থাৎ ইসলামি ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সব স্তরে ইসলামি শরিয়তের নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকাণ্ডের সব পর্যায়ে সুদ বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামি অর্থনীতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যাংক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও এ ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তথাপি ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো ব্যাংক ব্যবস্থার ইসলামিকরণের পথে দিন দিন উন্নতি করছে এবং শরিয়া অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যবৃন্দ লেনদেনগুলোর স্বচ্ছতা, ইসলামের অনুসরণ ও বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কারে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্য অর্জনে ইসলামি ব্যাংক আল-ওয়াদিয়াহ ও মুদারাবা পদ্ধতিতে মানুষের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শরিয়া অনুমোদিত ব্যবসায় ব্যাংক তার অর্থ বিনিয়োগ করে। বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে ইসলামি ব্যাংকগুলো জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠান শিল্প-বাণিজ্য ও অন্য ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে এবং লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণ করে। এটি শুধু লাভই হিসাব করে না, লোকসানের ঝুঁকিও বহন করে। সুদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে চলা ইসলামি ব্যাংকগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেÑএর আলোকে ইসলামি ব্যাংকগুলো কর্মপন্থা স্থির করে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর রয়েছে অনেকগুলো বেচাকেনা পদ্ধতি। বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-মুরাবাহা, বাই-সালাম, বাই-ইসতিসনা ও বাই আস-সর্ফ প্রভৃতি পদ্ধতিতে ইসলামি ব্যাংকগুলো গ্রাহকের সঙ্গে বেচাকেনায় অংশ নেয়। ব্যাংক অর্থের বিনিময়ে দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে এবং তা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে। এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে যে উদ্বৃত্ত তা ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে আসে। ব্যাংক ব্যবস্থার ইসলামিকরণে এ ধারা খুব পুরোনো নয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পরিধি বাড়ছে। ইসলামিক উইন্ডো চালু করতে শুরু করেছে নানা নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্যাংকও। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের এই অগ্রযাত্রার কথা অকপটে স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ১৯৫০-এর শেষ দিকে পল্লী এলাকায় একটি স্থানীয় ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথম ইসলামি ব্যাংক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মিসরের নীল নদের ব-দ্বীপে একটি পল্লী এলাকায় ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে মিত গমার সেভিংস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দ্বিতীয় নিরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। মিসরের উদাহরণ অনুসরণ করে মালয়েশিয়ায় ১৯৬৩ সালে এবং দুবাইতে ১৯৭৫ সালে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৫ সালে মুসলিম দেশগুলো একটি বহুজাতিক উন্নয়ন করপোরেশন হিসেবে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের এক সদস্য হয়। ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়।

দেশের পুরো ব্যাংক খাতের আমানত ও বিনিয়োগ উভয় দিক থেকেই এক-চতুর্থাংশ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দখলে। কভিডের কারণে যখন অন্য ব্যাংকগুলোর আমানতে টান পড়েছে, ঠিক তখনই এক লাখ কোটি টাকার বিশাল মাইলফলক অতিক্রম করেছে বেসরকারি খাতের ইসলামি ব্যাংক; যা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের জন্য নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের ৮.৬৪ শতাংশ এখন ইসলামি ব্যাংকের। এসব তথ্য অন্য ব্যাংকগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করছে। আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর আধিপত্য যে দিন দিন বাড়ছে, তা বলাইবাহুল্য। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং করলেও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩৯ বছরে নানা ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগ প্রদান ও রেমিট্যান্স আহরণে প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে ব্যাংকটি। দীর্ঘ এই সময়ে শিল্প খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে দেশকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ থেকে সহযোগিতা করেছে, তেমনি কৃষি খাতে অর্থায়নের মধ্য দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি  সড়ক, নৌপথ, এমনকি আকাশপথে যোগাযোগ স্থাপনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দেশের পরিবহন খাতকে করেছে উন্নত। এভাবে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহ জুগিয়ে দেশের পণ্য বিদেশে রপ্তানি বা বিদেশ থেকে দেশে পণ্য এনে বিক্রির জন্য অর্থায়ন করেছে ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে আছেন মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।  গ্রাহকসেবা আরও সহজ ও দ্রুততর করতে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবায় জোর দিচ্ছেন তারা। তাছাড়া ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত, রিটেইল ব্যাংকিং, কৃষি ও ভোক্তাঋণে জোর দিচ্ছেন তারা।

১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর মতিঝিলে ছোট পরিসরে চালু হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যায়নে টেকসই ব্যাংকের শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ১০ শতাংশই ইসলামি ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। আমানত সংগ্রহের বিষয়ে ব্যাংকটির এমডি বলেন, আমাদের বেশিরভাগ আমানতই এসেছে ছোট ছোট সঞ্চয় থেকে। করপোরেট আমানত খুবই নগণ্য। যার ফলে আমাদের আমানত খুবই স্থিতিশীল। এখনও আমরা ১০০ টাকা জমা রেখে আমানত হিসাব খুলি। আমরা ১০ টাকায় আমানত খুলতে শুরু করি ১৯৯৫ থেকে। শিক্ষার্থীদের হিসাব খোলার সুবিধাও দিচ্ছি আমরা। আমরা ১০০ টাকা দিয়েও মাসিক আমানত স্কিম খোলার সুযোগ দিচ্ছি। এর ফলে আমাদের দেখাদেখি ১০টি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গভাবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং করছে। সারাদেশে ১০০০ রাইস মিলে বিনিয়োগ করেছে ইসলামী ব্যাংক। পরিবহন খাতে ১ লাখ নিবন্ধিত গাড়ি ও ৫০০টি নৌযানে বিনিয়োগ রয়েছে ব্যাংকটির। এছাড়া ৫টি উড়োজাহাজেও বিনিয়োগ করেছে শরিয়াহভিত্তিক এই ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। রক্ষা রুরাল ডেভেলপমেন্ট স্কিমের (আরডিএস) মাধ্যমে যেমন রিকশাওয়ালাকে অর্থায়ন করেছে, তেমনি শ্যামলী পরিবহন, গ্রিনলাইন, হানিফ পরিবহন, সৌদিয়া, এস আলম পরিবহনের মতো বড় বড় পরিবহন প্রতিষ্ঠানে আমরা বিনিয়োগ করেছি। আবাসন খাতেও তাদের মোট বিনিয়োগের ১০ শতাংশের মতো বিনিয়োগ রয়েছে।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হলেও দেশের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সেবা দিচ্ছে ইসলামি ব্যাংক, মোট আমানতের ১০ শতাংশ গ্রাহকই নন-মুসলিম। তারা আদিবাসীদেরও অর্থায়ন করেছে। সাঁওতাল পল্লীতেও তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্য থেকেই বিনিয়োগ করছেন তাদের ব্যালান্সশিট সবার জন্য উš§ুক্ত। এখানে গোপন করার মতো কোনো বিষয় নেই। শতভাগ স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে সবকিছু করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালে আমদানি বাণিজ্য করেছে যথাক্রমে ৬৪ হাজার কোটি টাকা ও রপ্তানি বাণিজ্য করেছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার যথাক্রমে ১১.৪ শতাংশ ও ৮ শতাংশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রিটেইল ব্যাংকিং, কৃষি ও ভোক্তা ঋণের জোর দেয়ার  ইসলামী ব্যাংক কভিডকালে গ্রামে ফিরে যাওয়া ছোট উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করেছে। ছোট উদ্যোক্তারা তো জানে, কীভাবে ব্যবসা করতে হয়। কিন্তু গ্রামে হয়তো তারা সুবিধা করতে পারছে না। যদি তাদের অর্থায়ন করা হয়, তারা হয়তো গ্রামে বসেই নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে। খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার ইসলামি ব্যাংক এক্ষেত্রে খুবই ভালো অবস্থানে রয়েছে। নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে ইসলামি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টার্ট-আপ ফান্ড নিয়ে কাজ করছে। কারণ, একশটি স্টার্ট-আপের মধ্যে ৫টি সফল হয় আর তার মধ্যে দুই-একটি হয় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। এটা হলেও তা অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটতে পারে। দেশের ৬১টি ব্যাক এর মধ্যে অধিকাংশরেরই যেখানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে সেখানে ইসলামি ব্যাংকের বর্তমানে খেলাপি ঋণ এর পরিমাণ ৪৭৯২ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে এসে হঠাৎ করে এই পরিমাণ বেড়ে গেছে। যদিও এর আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বলতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না  বাংলাদেশের শক্তিশালী এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটিতে। হালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন করে পর্যবেক্ষক বসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। তারপরও ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকটি আস্থা ও বিশ্বাসে দেশের শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক