বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবার সমাজতত্ত্ব

[গতকালের পর]

ড. মতিউর রহমান : সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের ওপরও এমএফএসের প্রভাব লক্ষণীয়। দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের কাছে সহজে অর্থ পাঠানো এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হচ্ছে। এছাড়াও এমএফএসের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে আর্থিক লেনদেন সহজ হওয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যদিও এর কিছু নেতিবাচক দিকও থাকতে পারে, যা আলোচনার প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে এমএফএস বাংলাদেশের সমাজে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ, নিরাপদ ও উন্নত করেছে।

মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বাংলাদেশের সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে কিন্তু সুস্পষ্ট পরিবর্তন আনছে। প্রথমত, এটি ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও অভ্যস্ততা বৃদ্ধি করছে। একসময় যেখানে নগদ অর্থের ব্যবহারই ছিল প্রধান, এখন মানুষ ক্রমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। এই নতুন অভ্যাস শুধু আর্থিক লেনদেনের পদ্ধতিতেই পরিবর্তন আনছে না, বরং সামগ্রিকভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রসারও এই পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

দ্বিতীয়ত, আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নতুন রীতিনীতি ও প্রথার প্রচলন হচ্ছে। আগেকার দিনের লেনদেনের ধরন, যেমন- সরাসরি সাক্ষাৎ করে অর্থ প্রদান বা গ্রহণের পরিবর্তে এখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে বা প্রয়োজনে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে এমএফএস একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এমনকি ছোটখাটো কেনাকাটার ক্ষেত্রেও মোবাইল পেমেন্টের ব্যবহার বাড়ছে, যা ব্যবসায়িক লেনদেনের চিরাচরিত প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এই নতুন রীতিনীতিগুলো ধীরে ধীরে সমাজের দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হচ্ছে।

তৃতীয়ত, এমএফএস একটি প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। মানুষ এখন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা গ্রহণের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, যেখানে এমএফএস একটি গুরুত্বপূর্ণ পেমেন্ট মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এর মাধ্যমে একটি বৃহত্তর ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরি হচ্ছে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। এমএফএস তাই কেবল একটি আর্থিক সেবা নয়, এটি একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) দ্রুত প্রসার এবং বহুমাত্রিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান যা এর টেকসই উন্নয়ন এবং পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমত, অনিরাপত্তা ও জালিয়াতির ঝুঁকি একটি বড় উদ্বেগের কারণ। মোবাইল লেনদেনের ক্ষেত্রে হ্যাকিং, ফিশিং এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক কার্যকলাপের সম্ভাবনা থাকে, যা ব্যবহারকারীদের মধ্যে আস্থার অভাব তৈরি করতে পারে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নিয়মিত নজরদারি অপরিহার্য।

দ্বিতীয়ত, ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব এবং ডিজিটাল বিভাজন এমএফএসের একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও এমএফএস ব্যবহারের জ্ঞান এবং সচেতনতা তুলনামূলক কম। ফলে তারা প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে এবং এই সেবার সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনার জন্য ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং সহজবোধ্য ব্যবহারবিধি প্রণয়ন করা জরুরি।

তৃতীয়ত, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিশেষ করে দুর্বল নেটওয়ার্ক সংযোগ, এমএফএসের নির্বিঘ্ন কার্যক্রমের জন্য একটি বড় বাধা। দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও স্থিতিশীল এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের অভাব রয়েছে, যার ফলে এমএফএস লেনদেনে সমস্যা হয় এবং ব্যবহারকারীরা হতাশ হন। এই অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করার জন্য টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিস্তৃতি অপরিহার্য।

চতুর্থত, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অভাব এমএফএস সেক্টরের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। দ্রুত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই সেক্টরে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে কোনো প্রকার অনিয়ম বা অবৈধ কার্যকলাপ সংঘটিত হতে না পারে। একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং তার কার্যকর প্রয়োগ ব্যবহারকারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং এই সেবার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।

পঞ্চমত, এমএফএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান এবং গ্রাহক ধরে রাখার কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নতুন নতুন অফার এবং প্রণোদনার মাধ্যমে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই প্রতিযোগিতার ফলে অনেক সময় গ্রাহকরা বিভ্রান্ত হন এবং সেবার গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং গ্রাহক-বান্ধব নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যেতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলে এমএফএস বাংলাদেশের আর্থিক সেবা খাতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। প্রথমত, এমএফএস ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। একটি ক্যাশলেস সোসাইটি গঠন এবং সকল আর্থিক লেনদেনকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এমএফএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়, যা একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক।

দ্বিতীয়ত, এমএফএস ই-কমার্স এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেবার প্রসারে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। অনলাইন কেনাকাটা, ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রয় এবং অন্যান্য ইন্টারনেট-ভিত্তিক সেবার পেমেন্টের জন্য এমএফএস একটি সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম। এর ফলে ই-কমার্সের প্রসার দ্রুত হচ্ছে এবং মানুষ ঘরে বসেই বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছে। ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন ডিজিটাল সেবা যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমএফএসের গুরুত্ব আরও বাড়বে।

তৃতীয়ত, এমএফএস সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করতে পারে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তা সরাসরি উপকারভোগীদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে প্রেরণের মাধ্যমে বিতরণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীরা দ্রুত ও নিরাপদে তাদের প্রাপ্য অর্থ হাতে পান। সরকারের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকে আরও কার্যকরভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এমএফএস একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে।

চতুর্থত, এমএফএস খাতে নতুন নতুন উদ্ভাবনের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও উন্নত ও নিরাপদ আর্থিক সেবা প্রদান করা সম্ভব। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন ফিচার এবং অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করার সুযোগ রয়েছে, যা আর্থিক সেবা খাতকে আরও গতিশীল ও গ্রাহক-বান্ধব করে তুলবে। ফিনটেক (ঋরহঞবপয) উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এমএফএস একটি উর্বর ক্ষেত্র, যেখানে নতুন উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তিবিদরা তাদের সৃজনশীল ধারণা বাস্তবায়ন করতে পারেন। এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারলে এমএফএস বাংলাদেশের আর্থিক ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে এক গভীর ও বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলেছে। এটি একদিকে যেমন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করে ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় এনেছে, তেমনি রেমিট্যান্স বিতরণ সহজ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং সরকারি ভাতা বিতরণে স্বচ্ছতা আনয়নের মাধ্যমে এমএফএস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

একইসঙ্গে, লেনদেনের সুবিধা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি, সময় ও অর্থের সাশ্রয়, নারী ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নেও এর অবদান অনস্বীকার্য। ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও অভ্যস্ততা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনেও এমএফএস একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।

তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান, যেমন অনিরাপত্তা ও জালিয়াতির ঝুঁকি, ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অভাব। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুপারিশ ও দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করা জরুরি। এমএফএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। দেশের টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সংযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই সেক্টরের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।

এছাড়াও মোবাইল আর্থিক সেবার সমাজতাত্ত্বিক প্রভাবের আরও গভীরে অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে এর ব্যবহারকারীদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, গ্রামীণ ও শহুরে জীবনে এর প্রভাবের ভিন্নতা, বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সামাজিক পুঁজির ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণা করা যেতে পারে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে এমএফএস কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সমাজের ওপর তার নতুন কী প্রভাব পড়ছে, তাও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এই ধরনের গবেষণা নীতি নির্ধারক এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হবে, যা বাংলাদেশের আর্থিক সেবা খাতকে আরও উন্নত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।
[শেষ]

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী