Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 3:21 am

বাংলাদেশ: ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

মাযহারুল ইসলাম ফারাবী :বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-রাজনীতি ও অসীম সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র বিজয়, চীনের অন রোড ইনিশিয়েটিভ বা সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা সাত রাজ্যের প্রবেশ মুখ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, জলবায়ু বা ক্লাইমেট চেঞ্জ ইস্যুতে শক্ত অবস্থান ও নেতৃত্বের কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে চলে এসেছে।

২০১২ সালের ১৪ মার্চ জার্মানিতে অবস্থিত সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য অব দ্য সি (আই টি এল ও এস) রায় কর্তৃক মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিমি এবং ২০১৪ সালের ৭ জুলাই নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত পার্মানেন্ট কোর্ট অব অ্যাট্রিবিউশন রায়ে কর্তৃক ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়; যেটিকে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় বলে অভিহিত করা হয়।

মার্কিন সাবেক নৌবাহিনী চিফ বলেছিলেন; সমুদ্র যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে আগামী বিশ্ব তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর এ কৌশল নিয়েই পরাশক্তি ওয়াশিংটন সামনে এগোচ্ছে, কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন এখন এক নম্বরে উঠে এসেছে এবং সামরিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাই ওয়াশিংটন বেইজিংকে ঠেকানো ও বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কন্টেইনমেন্ট থিওরি (চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলার নীতি) স্ট্র্যাটেজি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্ট্র্যাটেজির অন্তর্ভুক্ত বিশেষভাবে বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর রয়েছে।

হাইডেন সিক্রেট হিসেবে কথিত আছে যে, ২০১৮ সালে আরাকানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে এবং স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে বঙ্গোপসাগরে নৌ-ঘাঁটি করার প্রস্তাব করেছিল।

বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ের ফলে এক বিশাল সম্পত্তি অর্জন ও ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা উšে§াচিত হয়েছে। সুতরাং ইকোনমিক সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। তারই অংশ হিসেবে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েয় সমুদ্র বিদ্যা বিষয়ক বিভাগ চালু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই মেরিন সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল। এগুলো সুনীল অর্থনীতিতে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এ সমুদ্র সম্পদ যথাযথ ব্যবহারের জন্য সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে  বিশেষজ্ঞ দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এবং নৌপথে অপরাধ কমানোর জন্য বিশেষ করে ড্রাগ, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, চীনের বহুল আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রুট ইনিশিয়েটিভ যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মহাসড়ক, রেল যোগাযোগের ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে বাণিজ্য কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ আঞ্চলিক অর্থনীতিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং সমুদ্র-তীরবর্তী দেশগুলোতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে ২১ শতকে মেরিটাইম সিল্ক রোড প্রতিষ্ঠা করা। এরই ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে একই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করেছে। যেমন পাকিস্তানের বেলিস্তানে গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দর, শ্রীলংকার হাম্বানটোটোতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চীন সরকার কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি করতে চেয়েছিল, এমনকি চীন সরকারকে প্রধানমন্ত্রী অর্থায়ন করতে আমন্ত্রণ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে ভারত সরকারের চাপে মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্বাক্ষর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। ভূ-রাজনীতি কলাকৌশলের ফলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। এটা পরিষ্কার যে, ভূ-রাজনীতির আধিপত্যে প্রতিবেশী দুই পরাশক্তি বাংলাদেশকে কাছে টানতে চাচ্ছে।

সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের ব্যাপক অংশীদারিত্ব রয়েছে। তিস্তা, মেট্রো রেল স্টেশনসহ বড় বড় প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আমাদের তিস্তা তীরবর্তী অঞ্চলের অর্থনীতি ও জাতীয় অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নে একান্ত ভূমিকা রাখবে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি প্রদেশের (আসাম, মেঘালয়, অরুনাচল, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা) ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক পরিবেশ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এসব প্রদেশের মানুষদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সবই স্বতন্ত্র। এ প্রদেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক, নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতা রোধে অনেকাংশ বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। এরা কোনো সময়ই ভারতের অংশ ছিল না। তার ওই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রদেশের স্বাধীনতা বিদ্রোহী গোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাচ্ছে। যেমন আসাম প্রদেশে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম বা উলফা এবং মিজোরামের ৮০ শতাংশ আদিবাসী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামরত। কিন্তু এই সেভেন সিস্টার রাজ্যে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হলো নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শিলিগুড়ি করিডোর; যাকে চিকেন নেক বলা হয়। চিকেন নেক যদি স্বাধীনতাকামী বা চীন কর্তৃক কোনো সময় আক্রান্ত হয় তাহলে তাহলে স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে মূল ভূখণ্ড থেকে একমাত্র পথ হলো বাংলাদেশ।

ঢাকা নয়াদিল্লিকে সেভেন সিস্টার্স যাওয়ার জন্য সমুদ্র ব্যবহারের ট্রানজিট ও নানান ইস্যুতে সুবিধা দিল দিলেও স্বাধীনতা উত্তর ছিটমহল বিনিময় ছাড়া ঢাকা তেমন উল্লেখযোগ্য সুবিধা পাইনি। গঙ্গা চুক্তি, তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি, টিপাইয়া মুখবাঁধ সমস্যা সমাধান, ভারতের বাজারে পণ্যের শুল্ক কমানো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সময়ের দাবি।

চতুর্থ, বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়; ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়ের পর প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ মিটিয়ে ফেলার পর দেশে সার্বভৌম অঞ্চল বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে সার্বভৌম ও  সমুদ্রের সার্বভৌম নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশের দেশে তিন বাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে ফোর্সের গোল ২০৩০ বাস্তব করছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে চীনের কাছ থেকে দুইটি সাবমেরিন ক্রয়, যা বাংলাদেশের কৌশল শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সাবমেরিনের সুষ্ঠু পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপদ জেটি সুবিধার জন্য কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার পেকয়ায় দেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি বানৌজা শেখ হাসিনার উদ্বোধন করা হয়েছে। ফোর্সেস গোল ২০৩০ লক্ষ্য পূরণে তাই বিভিন্ন দেশ যেমন তুর্কিয়ে, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ অনেক দেশে সামরিক অস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারই অংশ হিসেবে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্টার টিবি-ট্র– ড্রোন কিনছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রীয় হিসেবে তুরস্ক পুনরায় খিলাফত প্রতিষ্ঠা বা মুসলিম রাষ্ট্রে নেতৃত্বে বাংলাদেশকে কাছে চাই। জাহাজ শিল্পে উন্নতি করতে তুর্কিয়ের বিনিয়োগ,  তুর্কিয়ের রোহিঙ্গা ইস্যুতে আকুণ্ঠ সমর্থন, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও রাশিয়ার বিনিয়োগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনীতির ভূমিকা রাখবে।

পঞ্চমত, আঞ্চলিক নিরাপত্তা; ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার জঙ্গি দমনে জিরো টলারেন্স ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ভারতে ৭ রাজ্যে সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাচ্ছে যেমন নাগাল্যান্ডের ফেডারেশন ফ্রন্ট আর্মি, আসামে উলফা, প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার বিদ্যমান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আরাকানে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা সেলভেশন আর্মি সক্রিয়, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

তাই আঞ্চলিকা নিরাপত্তা, মাদক প্রতিরোধে দেশগুলোর তথ্য আদান প্রদান আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং যোগাযোগে ভূমিকা পালন করবে।

ষষ্ঠত, জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিকভাবে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ জলবায়ুু প্রভাবের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দেয়ার ফলে বাংলাদেশে ভূ-রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যদি ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাই তাহলে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাবে। সমুদ্রের উচ্চতার সঙ্গে শুধু জমি বিলীন হওয়ার পাশাপাশি অন্যত্র লবণাক্ততা দেখা দেবে, যা চারদিকে বিশুদ্ধ পানি সংকট, কৃষি, ফিশারির সেক্টর, প্রাকৃতিক দুর্যোগে  মানবীয় দুর্যোগ দেখা দেবে, যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এবং সামাজিক নিরাপত্তায় বাধার সৃষ্টি করবে। তাই জলবায়ুু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিশ্বনেতাদের সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

শিক্ষার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)