বাংলা আমার মায়ের

কাজী সালমা সুলতানা : বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারণের দাবি জানানো হয়।

এ সভা শেষে ছাত্রদের মিছিল-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। অবশ্য এর আগে ৫ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিভিন্ন প্রদেশে প্রাথমিক স্তরের আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৪৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে নবগঠিত তমদ্দুন মজলিস একটি বই প্রকাশ করে। বইটির নাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা-বাংলা না উর্দু’। এ বইয়ে তারা বাংলা ও উর্দু  উভয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করে।

এদিকে একই বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে গঠিত করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।

পূর্ববঙ্গে যখন ভাষা আন্দোলন জোরদার রূপ ধারণ করেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তখন বাংলার দাবির প্রতি ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। সে সময় শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলা ভাষাকে বিষয় তালিকা হতেও বাদ দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় স্ট্যাম্প ও মুদ্রায় বাংলা ভাষার ব্যবহার। 

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পুরোদমে শুরু হয়। এ বছরের ১১ মার্চ ঢাকার ছাত্রসমাজ পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার প্রতিবাদ জানায়। ধর্মঘট প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে এদিন প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হয়।

ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মুখে সেদিন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এ চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন কামরুদ্দীন আহমেদ।

সেদিন ছাত্রবিক্ষোভে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ হয়; এতে বহু ছাত্র আহত হয়। পাকিস্তান সরকারের এই দমননীতির ফলে ছাত্রদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন আরও জোড়দার হয়। ১১ মার্চ থেকে প্রতিদিন ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল), বর্ধমান হাউসে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবনে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করতে থাকে।

একপর্যায়ে  তারা  তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে।