Print Date & Time : 10 August 2025 Sunday 1:48 am

বাংলা আমার মায়ের ভাষা

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জš§ হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির  শুরুতেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদে প্রাধান্য পায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে থাকেন।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। শুরুটা করেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য রাজনীতিবিদ কমরুদ্দিন আহমেদ। তিনি পূর্ববাংলার ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের ঘোষণায় বলা হয়Ñ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যুগোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’

ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল ভাষার বিষয়ে একটি চূড়ান্ত  দাবিনামা তৈরি করে। এই দাবিনামার মধ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ও সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সামনে রেখে প্রথম আন্দোলন সংঘটিত করে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এর নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ধীরে ধীরে অনেক প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সংগঠনও বাংলাভাষারকে রাষ্ট্রভাষা দাবির আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। এভাবে একসময় ভাষার দাবি গণআন্দোলনে পরিণত হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পরেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জোর প্রচেষ্টা চালান। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করে। এ সভা শেষ হওয়ার পরও মিছিল-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে।

এদিকে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে গঠিত করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরের বছর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন। এই অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু সেদিন পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবের সংশোধনী এনে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের ছয় কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক। এই অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানসহ কেন্দ্রীয় নেতা এবং পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বিরোধিতা করলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবি বাতিল হয়ে যায়।

এ খবর ঢাকায় পৌঁছলে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়ার তীব্র সমালোচনা করে। তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার করার এই পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হন শামসুল আলম। এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন।