বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছে তরুণ সমাজের বড় অংশ

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ প্রতিনিয়ত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখে। প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব স্বকীয়তা অনুযায়ী আচরণ করে থাকে। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায়, চারপাশের কিছু মানুষের মধ্যে তাদের আচরণের অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটছে। তারা সামান্য বিষয়ে তীব্র আনন্দ কিংবা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। যেকোনো ছোট ভুলের জন্য নিজেকে দোষী মনে করতে থাকে। এমন সময় ব্যক্তির স্বাভাবিক নিদ্রা আসে না ও দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ক্রোধে নিকটবর্তী মানুষের ওপর গায়ের জোর প্রয়োগের চেষ্টা করে। চরম পর্যায়ে গিয়ে আত্মহত্যা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় একে বলা হয় বাইপোলার ডিসঅর্ডার। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের ভারসাম্যহীন কিংবা উš§াদ মনে হতে পারে; কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে এই রোগের চিকিৎসা করা নিয়ে তীব্র অনীহা থাকার কারণে কোনো উপর্যুপরি পদক্ষেপ নেয়া যায় না।

দীর্ঘসময় ধরে একজন ব্যক্তির আচরণ, আবেগ বা মানসিক অবস্থার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে। এই রোগের দুইটি পর্যায় লক্ষ করা যায়, একজন ব্যক্তির মানসিকতার একপর্যায়ে থাকে উৎফুল্লতা, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রবণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ম্যানিয়া পর্ব। অপর পর্যায়ে থাকে বিষণ্নতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ডিপ্রেশন পর্ব। এই সময় ব্যক্তির কোনো কিছুই ভালো লাগে না, হতাশায় ভোগেন, দুঃখবোধ প্রবল থাকে। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। বিভিন্ন কারণে মানুষের এই রোগ হয়ে থাকে। মানসিক ভারসাম্যহীনতা, স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক রোগের ভুল চিকিৎসা প্রভৃতি কারণে বাইপোলার ডিসঅর্ডার হতে পারে। ম্যানিয়া পর্ব চলাকালীন রোগী মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অতি উৎফুল্ল মনোভাব লক্ষ করা যায়। ব্যক্তি নিজের মধ্যে প্রচণ্ড উদ্দামতা অনুভব করতে থাকে। নিজেকে বিশাল শক্তিশালী, বড় কেউ, ক্ষমতাশালী মনে করতে শুরু করে। তার মধ্যে হঠাৎ রেগে যাওয়া, ঝগড়াঝাটি বা মারামারি করা ও কোনো কাজের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলার লক্ষণ দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে ঘুম এলেও ঘুমাতে না চাওয়া ও বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়।

ম্যানিয়া পর্বের সম্পূর্ণ বিপরীত হচ্ছে ডিপ্রেশন পর্ব। এই পর্ব চলাকালীন দীর্ঘসময় বা দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্নতা কিংবা হতাশায় ভুগতে দেখা যায়। এমন সময় আক্রান্ত ব্যক্তি বিনা কারণে কান্নাকাটি করে, খুবই সামান্য বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। জীবনের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় দিনাতিপাত করতে থাকে। নিজেকে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বলে মনে করতে থাকে। ছোটখাটো কাজে অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো আত্মহত্যার প্রবণতা। ব্যক্তি জীবনে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ পরপর মরে যেতে চাওয়া বাইপোলার ডিসঅর্ডারের অন্যতম লক্ষণ।

বাংলাদেশে প্রতি হাজারে চারজন ব্যক্তি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। আমাদের দেশে সাধারণ ২০-২৫ বছর বয়সে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকট হয়। শৈশবকালীন পারিবারিক অস্থিরতা ও নির্যাতন, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ও বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এসব ব্যক্তিদের বেশিরভাগ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। গত ২০ বছরে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬ শতাংশের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেছে। এই রোগে আক্রান্ত প্রতি দুইজন ব্যক্তির মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ বিভিন্নভাবে নিজেদের ক্ষতি সাধন করেছে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই বললেই চলে। তবে এ রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে হবে। পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিলে রোগীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। সর্বোপরি, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

 

কাজী খবিরুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়