প্রতিনিধি, দিনাজপুর: দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় চলতি আমন মৌসুমের ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানে শুরুতে দেড় মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো ধান কিনতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। ধান শুকনো হওয়া, ব্যাংক থেকে তোলাসহ গুদামে ধান দিতে গেলে নানা ঝামেলা পোহাতে হয় বলে অভিযোগ কৃষকদের। আবার সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলাবাজারে বেশি দাম পাওয়ায় গুদামে ধান দিতে অনীহা তাদের। পাশাপাশি উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম কম পাওয়ায় গুদামে চাল দিতে আগ্রহী নন চালকল মালিকরাও। এতে চলতি মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে আশাবাদী খাদ্য বিভাগ।
গত ১৭ নভেম্বর দিনাজপুর অঞ্চলে আমন মৌসুমের ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধন করা হয়, যা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। সে অনুযায়ী হাকিমপুরে গত বছরের তুলনায় এক টাকা বাড়িয়ে ৩৩ টাকা কেজি দরে ৫৬৪ মেট্রিক টন ধান ও দুই টাকা বাড়িয়ে ৪৭ টাকা কেজিতে ১৩৭ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এ ছাড়া ৪৬ টাকা কেজি দরে ৭৩ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে কৃষকরা আমন ধান কাটা ও মাড়াই শেষে জমিতে আলু কিংবা সরষে লাগিয়েছেন। বর্তমানে অধিকাংশ কৃষকের কাছে তেমন কোনো ধান নেই। তারা খোলাবাজারে ও আড়তদারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক মুঠো ধানও কিনতে পারেনি খাদ্য বিভাগ।
কৃষকরা বলছেন, সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারে দাম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ধান শুকনো হতে হয় এবং ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হয়—এমন ঝামেলার কারণে খাদ্যগুদামে ধান দিতে আগ্রহ নেই তাদের। সরকার ধানের মণ এক হাজার ৩২০ টাকা নির্ধারণ করলেও বর্তমানে খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪৫০-৫০০ টাকায়। চালকল মালিকরা বলছেন, বেশি দামে ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে ৫০ টাকা পড়ছে কেজি। অথচ সরকার গুদামের জন্য দাম নির্ধারণ করেছে ৪৭ টাকা। এতে লোকসান হওয়ায় গুদামে চাল দিতে আগ্রহী নন চালকল মালিকরা। লাইসেন্স বাঁচানোর তাগিদে কেউ কেউ চাল দিলেও অধিকাংশ মালিক চুক্তিবদ্ধ হননি। ১৩ জন চুক্তিবদ্ধ হলেও চাল সরবরাহ করেছেন মাত্র তিনজন। এতে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় আছে।
সরকারি গুদামে ধান দিতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয় বলে উল্লেখ করেছেন হিলির ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের কৃষক আসলাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘তারা চায় শুকনো ধান, টাকা নিতে হয় ব্যাংক থেকে। আবার খোলাবাজারের তুলনায় দাম কম। মণ এক হাজার ৩২০ টাকা, অথচ বাজারে এক হাজার ৪৫০-৫০০ টাকা বিক্রি করছি। তাহলে কেন লোকসান দিয়ে ঝামেলা নিয়ে সরকারি গুদামে ধান দিতে যাব।’
হিলির আরেক কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ‘ভ্যানে করে গুদামে ধান নিয়ে যেতে হয়। এতে বাড়তি খরচ হয়। আবার শুকনো না হলে মিটার পাস নেই—এমন অজুহাতে গুদাম থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। দালালরা ঘুষ চায়, বলে টাকা দিলে পাস করিয়ে দেবে। আড়তে কিংবা বাজারে নিয়ে গেলে এসব ঝামেলায় পড়তে হয় না। কোনো কোনো ব্যাপারী বাড়ি থেকে ধান কিনে নিয়ে যান। গুদামের চেয়ে বাড়তি দাম পাচ্ছি। সবকিছু মিলিয়ে বাজারে ও আড়তে সহজে বিক্রি করতে পারায় গুদামে ধান দিচ্ছি না আমরা।’
হিলির দুদু চালকলের (হাসকিং মিল) স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি, তাই বাধ্য হয়ে গুদামে চাল সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু চাল সরবরাহ করে লাভ তো দূরের কথা উল্টো লোকসান গুনতে হবে। অন্যান্য বারের তুলনায় এবার ধানের দাম বেশি। চাল না দিলে সরকার কালো তালিকাভুক্ত করবে, লাইসেন্স বাতিলসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেবে। এসব কারণে লোকসান দিয়ে হলেও গুদামে চাল দিতে হবে। এক হাজার ৪০০ টাকা মণ ধান কিনে চালের কেজিতে খরচ পড়ছে ৫০ টাকার বেশি। অথচ সরকারি গুদামে ৪৭ টাকা কেজি দরে চাল দিতে হয়। সরকার যদি চালের দাম অন্তত ৫০ টাকা করত, তাহলে সবাই গুদামে সরবরাহ করত। চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হতো।’
এ ব্যাপারে হাকিমপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খালেদা বানু বলেন, ‘চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৫৬৪ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেদ্ধ চাল ১৩৭ টন কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৯ টন চাল কিনতে পেরেছি। এ ছাড়া আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৭৩ টন ছিল, এরই মধ্যে তা পূরণ হয়েছে। তবে চাল সংগ্রহ শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধান সংগ্রহ করতে পারিনি। এর কারণ হলো ধানের সরকারি মূল্য কম। সে তুলনায় বাজারে বেশি পাওয়ায় কৃষকরা ধান দিচ্ছেন না। সামনের দিনে যদি বাজারদর কিছুটা কমে তাহলে হয়তো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। যেহেতু ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে, হয়তো ধান সংগ্রহ করতে পারব আমরা।’
যেসব মিলার চাল দেবেন না কালো তালিকাভুক্তসহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ করে খালেদা বানু বলেন, ‘যেসব মিলার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও চাল দেবেন না, তাদের লাইসেন্স বাতিলসহ আইনি যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলো গ্রহণ করা হবে। তবে আশা করছি, চুক্তিবদ্ধ সব মিলার চাল সরবরাহ করবেন।’