শেখ শাফায়াত হোসেন : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এ বাজেট ঘিরে নানা ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিগত বছরগুলোর গতানুগতিক বাজেট অর্থাৎ আয়-ব্যয় আর ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংকঋণ নির্ভরতার বাজেট প্রণয়নের ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন তারা। করমুখী বাজেটের পরিবর্তে তারা চান উৎপাদন সহায়ক বাজেট।
এবারের বাজেট উপস্থাপনের ভার যার কাঁধে তিনিও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বাজেটের এমন পরিবর্তনের কথাই বলে আসছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়া ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার সেই কাক্সিক্ষত বাজেট পেশ করবেন। এই বাজেট হবে চলতি অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ছোট এবং সংসদের বাইরে ঘোষণা করা হবে।
এবারের বাজেট নিয়ে অর্থনীতির গবেষকরা বলছেন, প্রতিবছর বাজেট বড় করার একটি প্রবণতা ছিল বিগত বছরগুলোয়। কর আরোহণ বরাবরই লক্ষ্যের থেকে পিছিয়ে থাকত। ঘাটতি বাজেটে ব্যাংকঋণ নির্ভরতা থেকেই যেত।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম।
আরও জানা গেছে, এ বাজেটের মূল লক্ষ্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং স্বল্প আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেয়া।
সাংবিধানিক কাঠামোর ব্যত্যয় এবং সংসদ না থাকায় এবার সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। ফলে আসন্ন বাজেটটি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিসহ বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে সম্প্রচার করা হবে।
আসন্ন বাজেট সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, এবারের বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হবে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত আয় আসবে ১৯ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত আয়ের লক্ষ্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা। মোট ব্যয় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবনা আসতে পারে। সেই হিসাবে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা হবে।
এই ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ ু৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
আসন্ন বাজেট সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে অর্থবছর শেষে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫.৫ শতাংশ।
বাজেট পরিকল্পনায় গ্রামীণ অবকাঠামো, রাস্তাঘাট সংস্কার, নির্মাণ কাজে জোর দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা থাকতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে বলেও জানা গেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি পর্যায় থেকে রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৮২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা।
এদিকে শুল্ক যৌক্তিকীকরণের অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছর থেকে বিভিন্ন শুল্কস্তর পুনর্বিন্যাস করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। বর্তমানে আমদানি শুল্কের ছয়টি স্তর রয়েছে। এগুলো হলো ০, ১, ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছর থেকে একটি স্তর বাড়িয়ে সাতটি করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের স্তরগুলো হবে ০, ১, ৩, ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ শতাংশ। সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রে বর্তমানে ১২টি স্তর রয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকে তা ১৩টি স্তরে উন্নীত করা হচ্ছে। বর্তমান সম্পূরক শুল্কস্তরগুলো হচ্ছে ১০, ২০, ৩০, ৪৫, ৬০, ১০০, ১৫০, ২০০, ২৫০, ৩০০, ৩৫০ ও ৫০০ শতাংশ। আগামী অর্থবছর থেকে যে ১৩টি স্তর হবে, সেগুলো হচ্ছে ১০, ২০, ৩০, ৪০, ৪৫, ৬০, ১০০, ১৫০, ২০০, ২৫০, ৩০০, ৩৫০ ও ৫০০ শতাংশ। এ ছাড়া যেসব পণ্য আমদানিতে সর্বোচ্চ পরিমাণ, তথা ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে, সেগুলোর ওপর থেকে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার হতে পারে।
শুল্ক যৌক্তিকীকরণের অংশ হিসেবে যেসব বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হবে, তেমনটি নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানোও হবে। তেমন একটি পণ্য তামাকের বীজ। তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি পণ্য। তাই এটির চাষাবাদ নিরুৎসাহিত করতে চায় সরকার। বর্তমানে তামাকের বীজ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হয় না। আগামী অর্থবছর থেকে তামাকের বীজ আমদানিতে ২৫ শতাংশ বসানোর প্রস্তাব আসতে পারে। এ ছাড়া পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য। পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকার সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে চায়। সেজন্য এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের তৈজসপত্রের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়তে পারে।
সিমেন্টশিল্পে কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানির শুল্ক-কর পুনর্নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া চমড়াশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ শিল্পের জন্য ওয়্যারহাউস সুবিধা আছে। কিন্তু এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কেমিক্যাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। এ শিল্পের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আগামী অর্থবছর থেকে এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাসায়নিক আমদানির শুল্ক কমানো হতে পারে।