আইসিএবি-ইআরএফ আলোচনা সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী

বাজেট বরাদ্দে প্রয়োজনীয়তার চেয়ে রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পায় 

নিজস্ব প্রতিবেদক: পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, বাজেট বরাদ্দে প্রয়োজনীয়তার চেয়ে রাজনীতি গুরুত্ব পায় বেশি। এই বরাদ্দ দিতে গিয়ে সরকার এক ধরনের ‘ঠেকা’র মধ্যে পড়ে। কায়েমি স্বার্থ বরাদ্দ বিভাজনকে প্রভাবিত করে। বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা গণতান্ত্রিক সমাজে থাকা উচিত নয়। হঠাৎ করে এই বেড়াজাল ভাঙ্গা সহজ নয়। তবে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন। আশা করা যায় তিনি সফল হবেন।

 ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় গতকাল পরিকল্পনামন্ত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। আইসিএবি সভাপতি শাহাদাৎ হোসেনের সভাপতিত্বে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে ‘সামষ্টিক অর্থনীতি: ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যশা’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচনায় ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও হিসাববিদরা রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার, করপোরেট কর কমিয়ে আনা, করোনা প্রভাব মোকাবিলা এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে করণীয়, এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার খুবই জরুরি। অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারি বরাদ্দ দেয়া অন্যায়। তিনি বলেন, অনেক সমস্যার মধ্যেও বর্তমান সরকার গত ১০ বছরে লক্ষণীয়, দৃশ্যমান ও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নয়ন করেছে। দেশে ব্যবসায় পরিবেশে সমস্যা আছে। তবে বড় সমস্যা হচ্ছে একটি শ্রেণি বলছে, তারা নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তারা খেলা ভণ্ডুল করার প্রয়াস থেকে এসব বলছে। এ ধরনের মতামতের বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজকে মতামত জানানোর আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন আইসিএবি সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, দেশ এগোচ্ছে। তবে বৈষম্যও বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে পরোক্ষ কর। তিনি প্রত্যক্ষ কর ও অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিবর্তে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি স্বয়ংক্রিয় রাজস্ব ব্যবস্থা, করের অর্থের সঠিক ব্যবহার, সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোসহ সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, বাজেট থেকে যে বিনিয়োগ হয় সেখানে সংস্কার দরকার। শিক্ষা খাতের জন্য পূর্ণাঙ্গ বাজেট দিতে হবে। তিনি বলেন, জাতির জনক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তখন ডিজিপি ছিল মাত্র ১৪ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কেন জাতীয়করণ হবে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ভালো হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সুচিন্তিত পদক্ষেপ দরকার। আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এখন রিজার্ভ খরচের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এখন সুদহারে সর্বোচ্চ সীমা রাখা ঠিক হবে না। তিনি করনীতি ও কর প্রশাসনকে আলাদা করা, এসএমই খাতের বিকাশের জন্য গ্যারান্টি স্কিম বাড়ানো, ভ্যাট আইন সংস্কারের প্রস্তাব দেন।

এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক কাজ করা সম্ভব হয়নি। ফলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। কারণ এ পরিকল্পনা যখন করা হয়েছিল, তখন করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল না। তিনি করপোরেট কর কমানো ও সব ধরনের রপ্তানিতে সমান সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেন।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ শতাংশের বেশি ধরা ঠিক হবে না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, খাদ্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে উদ্যোগ দরকার। পাশাপাশি পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে; যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সমস্যায় না পড়েন।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘অগ্রিম আয়কর নেয়া বন্ধ করতে হবে। অগ্রিম আয়কর বাবদ যে টাকা সরকারের কাছে যেত, সেই টাকা কোম্পানিগুলো যাতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি উৎসে কর নেয়া বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ছাড়া অন্য কেউ এ কর নেয় না। কর সবাই দিতে চায়, কিন্তু করের ঝামেলা কেউ নিতে চায় না। এ জন্য কর কর্তৃপক্ষের সংস্কার দরকার। এনবিআর মনে করে তারা রাজা, আর করদাতারা প্রজা। সবাইকে জোর করে ধরতে চায়।’ তিনি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাপেক্সকে শক্তিশালী করা, কয়লা উত্তোলন বাড়ানো ও পিপিপিতে ভালো প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।

ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার ই-কমার্স খাতে কর কমানো ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রস্তাব করেন।

প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম বলেন, ‘সরকারের দেয়া প্রণোদনা কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।’ খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি। একইসঙ্গে সরকারের ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন এ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, শিল্প খাতের অর্থায়নের অতিমাত্রায় ব্যাংকনির্ভরতা দূর করতে পুঁজিবাজার ও বন্ড বাজারকে উন্নত করতে হবে। এছাড়া আইসিএবির সিইও শুভাশীষ বসু, ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।