করোনাকালে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সব দেশই স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও কঠিন পরিস্থিতির শিকার। নিরাপদ থাকতে নিজেদের একপ্রকার ‘বিচ্ছিন্ন’ করে রাখতে চেয়েছে সবাই। স্টেডিয়ামের খেলা, বৈশ্বিক আয়োজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞায় লোকসানে পড়ছে এয়ারলাইনস ও পর্যটন। প্রধান সব শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। রেমিট্যান্স-প্রবাহে ভাটা পড়েছে। এমন কোনো খাত নেই, যেখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। কভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব দেশই প্রণোদনা, বিশেষ ভাতা ও সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়েছে।
আগামী কয়েক প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে, বলছেন কেউ কেউ। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও মন্দায় পড়বে, এমন পূর্বাভাসও রয়েছে। এ অভিঘাতে প্রবাসী-আয়, রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান কমলে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হলে আমাদেরও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করা বড় কঠিন হবে। বিশেষজ্ঞদের অভিন্ন অভিমতÑমূল সমস্যা ‘করোনা’ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করা গেলেই পূর্বাবস্থায় ফিরবে দেশ; ‘নতুন স্বাভাবিক’ কারও প্রত্যাশিত নয়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় করোনার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা বলছেন সবাই। অথচ বাজেট পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, কভিড মহামারি নিয়ে নীতিনির্ধারকরা শিথিলতা দেখাচ্ছেন। সানেম আরও বলেছে, মহামারির মধ্য দিয়ে আমরা সময় পার করছি। তাই নতুন বাজেটও সেভাবে হওয়া আবশ্যক। অথচ মহামারির বিষয়টি এবারের বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলেই আমরা মনে করি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, দারিদ্র্য, বৈষম্য প্রভৃতি সামাজিক বিষয়ে সুস্পষ্ট কর্মসূচি ও প্রকল্প নিতে হবে।
বাজেট নিয়েও বিভিন্ন মূল্যায়ন রয়েছে। এটি যথানিয়মে বাস্তবায়ন করা হয় না। বছর শেষে সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। কভিডের অভিঘাতে জনসংখ্যার বড় অংশ সাংসারিক খরচে কমাতে বাধ্য হয়েছে। বলা যায়, দেশের শিশু-কিশোর প্রয়োজনীয় খাদ্য না পেয়ে অপুষ্টির শিকার হবে। তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তারা কর্মক্ষম জনবল হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই কভিড-অভিঘাত মোকাবিলায় থোক নয়, খাতভিত্তিক বরাদ্দ প্রয়োজন। কভিডকালে যারা নতুন করে গরিব হয়েছেন, তারা সরকারের সহায়তা পাবেন কি না, তা অনিশ্চিত। কভিডকালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা ও অনিয়ম সামনে এসেছে। এখন এ খাতের সংস্কারে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে। বাজেট ব্যবসাবান্ধব হোক, স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন উপেক্ষিত না থাকে। করোনাকালের বাজেটে অবশ্যই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে। কী বিবেচনায় কোন খাত অগ্রাধিকার পাচ্ছে, তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবেÑস্পষ্ট হওয়া দরকার।
সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান যেভাবেই হোক সাধারণ মানুষ যেন স্বস্তি ও ন্যূনতম মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, টিকে থাকতে পারে। এর চেয়ে বেশি চাওয়া তাদের নেই। সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা বঞ্চিত গরিব মানুষ যেন নতুন করে বঞ্চনার শিকার না হন। সাধারণ মানুষকে রক্ষায় রাষ্ট্র বাজেটকে মহামারির অভিঘাত মোকাবিলায় সক্ষম করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলেই প্রত্যাশা।