বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তিকর করতে আমরা কতটা প্রস্তুত

রেজাউল করিম খোকন : অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন সোমবার আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। প্রতি অর্থবছরে জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবারকে বাজেট ঘোষণার জন্য বেছে নেয়া হয়। এবারই তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। তবে বাজেট ঘোষণার পরদিন রেওয়াজ অনুযায়ী অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন ঠিকই করবেন অর্থ উপদেষ্টা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্র্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট। এবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের দেয়া বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন জাতীয় সংসদে। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে।

সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। এ ছাড়া এবারের বাজেটে নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বাজেটে। চাইব মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয়। এত কিছু কীভাবে করা সম্ভব হবে-একজন অর্থনীতি বিশ্লেষক হিসেবে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে। রাজস্ব তো পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আমরা আশাবাদী, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব বাড়বে। সরকার এরই মধ্যে এনবিআরকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে দুটি পৃথক বিভাগ সৃষ্টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের সবার প্রত্যাশাÑমানুষের ওপর অহেতুক করের বোঝা বাড়াবে না সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা, কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব-ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ। যেখানে রাজস্ব আয় চার লাখ কোটি টাকা করতেই ঘাম ছুটে যায়, সে বিবেচনায় আগামী বাজেটও উচ্চাভিলাষী হবে। এতে ঘাটতি বড় হবে। এটা কোনোভাবেই ছোট বাজেট হবে না, মূল্যস্ফীতি কমার বাজেটও হবে না, এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ার বাজেটও হবে না। সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা মানে হচ্ছে, কল্পনার সঙ্গে কল্পনার তুলনা করা। অনেকটা এ রকম-আগের সরকার চাঁদে যাওয়ার কথা বলেছিল, এখন বলা হবে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার কথা। আগের সরকার যে বাজেট ঘোষণা করত, তার অনেকটাই অবাস্তবায়িত থাকত। শেষ পর্যন্ত বাজেটে ঘোষিত বিষয়গুলো অসার বলে প্রমাণিত হতো। স্রেফ জনগণের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করতে স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী সরকার নিজেদের কৃতিত্ব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশ করতেই এক ধরনের স্টান্টবাজি করত। আমরা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলের দেয়া বাজেটগুলোয় এটি বারবার লক্ষ করেছি। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। তারা ক্ষমতার মঞ্চ থেকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাদের কৃতকর্মের কারণে। এখনও যদি আগের মতো অবাস্তব, কাল্পনিক এবং সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাজেট প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেটা হবে চরম দুঃখজনক। এখন সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে রয়েছেন একজন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, যিনি একাধারে মেধাবী ও অসাধারণ উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যয় করেছেন। এজন্য তার প্রবর্তিত গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্ভাবক হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। তেমন একজন অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে দেয়া বাজেট যথাসম্ভব বাস্তবসম্মত, জনকল্যাণকর, দারিদ্র্যবান্ধব এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম চাপ সৃষ্টিকারী একটি চমৎকার সুন্দর বাজেট হিসেবে পরিগণিত হবে, তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এটাও আশা করি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন থাকবে বাজেটে ।

বর্তমান সরকার আগের সেই ঘোষিত বাজেটের চেয়ে মোট ব্যয় সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে দুভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সংস্থাটি ভেঙে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিসিএস আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করেই বহুল আলোচিত ‘রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। জারি করা অধ্যাদেশে শুধু রাজস্বনীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্বনীতি বিভাগ কর আইন প্রয়োগ ও কর আদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। রাজস্ব সংগ্রহের মূল কাজ করবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে কম ঋণ নেবে সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আগামী অর্থবছরেও তা-ই থাকছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার হতে পারে। এ বাজেট থেকেই ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আগামী অর্থবছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হবে। বাজেট-ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রতি অর্থবছরেই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশের আশপাশে রাখা হয়। কখনো পাঁচ শতাংশের একটু বেশি থাকে বাজেট-ঘাটতি, কখনোবা পাঁচ শতাংশের কম। তবে আগামী অর্থবছরে বাজেট-ঘাটতি ৪ দশমিক ২ শতাংশ রাখা হতে পারে। এ বাজেট-ঘাটতি পূরণে অবশ্য বেশিরভাগ ঋণই নেয়া হবে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার ৭০০ কোটি এবং দেশি বা অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। বাকি ঋণ সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে নেয়ার পরিকল্পনা সরকারের। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা একটু বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুন শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত বছরের জুন শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকায়, চার বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে চার বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেশি হওয়ার কারণে সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে আগামী বাজেটেও। আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক লাখ টাকা কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই ব্যয় হবে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। আমাদের মূল সমস্যা রাজস্ব আদায়ে। রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সরকারকে এত বেশি ঋণ নিতে হতো না। আমার ধারণা, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে আগামী অর্থবছরে সরকার বেশি ঋণ নেবে না; বরং সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি থেকে ভালো অর্থ সংগ্রহ করবে। গত জানুয়ারি থেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেড়েছে। তাই মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।

বাজেট-ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার দুইভাবে ঋণ নেয়। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে, অন্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যায় ব্যাংকগুলোর। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তাতে ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের। অর্থনীতিরই সূত্র এটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকঋণ অন্যতম কারণ হলেও সরকারের হাতে তেমন বিকল্প নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার পুরো সরকার ঋণ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেয় না।

চলতি অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেট তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ নিলে তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার ব্যাংকঋণের সুদ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা মূলত রাজস্ব সংগ্রহের অর্থ। আগামী অর্থবছরে এসব বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট যদি ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাখা হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা যথেষ্টই ছোট হচ্ছে। আমাদের মূল নজর দিতে হবে রাজস্ব সংগ্রহে। বিশ্বের সর্বনিম্ন রাজস্ব-জিডিপির হার বলেই অতি জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে। একই কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার ভালো বরাদ্দ রাখতে পারছে না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে ১ নম্বর অগ্রাধিকারে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সাজাচ্ছে সরকার। বাজেটে সুযোগ তৈরি করা হবে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের। এ জন্য উজ্জীবিত করা হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের কর্মযজ্ঞকে। তবে বড় তেমন কোনো প্রকল্প নেয়া হবে না, করা হবে না ঢাউস আকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি)। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। এমনকি বাড়ানো হবে ভাতাভোগীর সংখ্যা। সবই করা হবে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকেও। রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট তেমন বড় করা হচ্ছে না। এ কারণেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা। অহেতুক উচ্চাভিলাষী নয়; বরং একটি বাস্তবভিত্তিক বাজেটের দিকেই এগোচ্ছে অন্তর্র্বতী সরকার। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯-১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। সরকার প্রথমে আগামী অর্থবছর শেষে এ হার সাত শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ায় এ হার আরও কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী।

চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট-ঘাটতি জিডিপির পাঁচ শতাংশের নিচে রাখা হবে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কিছুটা কমিয়ে ইতোমধ্যে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশের নিচে থাকবে। এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। আগামী বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বাজেট-ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা বেশ কমানো হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সহায়ক। এটা সরাসরি মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পরেও প্রস্তাবিত বাজেটে-ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা বেশ বড়ই রয়ে গেছে। এজন্য ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার বড় লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে তা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। ফলে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরেও চাপ তৈরি করবে। নতুন বাজেটে আরও কিছু বিষয়, যেমন সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে বিকল্প উৎস তৈরি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত পরিস্থিতির উত্তরণ, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর কমানোর মতো কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় শিল্পায়ন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, করজাল সম্প্রসারণ, ঘাটতি মেটাতে আর্থিক খাত-নির্ভরতা কমানোর ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই কঠিন অর্থনৈতিক চাপের মুখেও সময়োচিত বাজেট প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট-ঘাটতি যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি করহার না বাড়িয়ে করের পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টাও আছে সেখানে। এ ছাড়া সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও মান বাড়ানোর চেষ্টাও আছে। আশা করছি, বাজেটে যে ইতিবাচক উদ্যোগগুলোর কথা বলা আছে, সরকার দ্রুততম সময়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। এটিই হবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্র্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, নতুন বাজেট অগ্নিমূল্যের বাজার থেকে স্বস্তি দেবে। মধ্যবিত্তের আশা, টিসিবির ট্রাকের পেছনে মুখ লুকিয়ে আর দাঁড়াতে হবে না। বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছেÑসবার আশা কি পূরণ করতে পারবে এই বাজেট? স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫-১৬ বছর শাসনামলে মানুষ অনেক কষ্ট করেছে। তাই আশার আলোর সন্ধানে সবাই। কিন্তু টানেলের শেষে কি আশার আলো দেখা যাচ্ছে?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট