সৈয়দ আলমাস কবীর: নির্বাচন-পূর্ববর্তী বছরে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট উত্থাপিত হতে যাচ্ছে এই সপ্তাহেই। আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলনের হিসাব নিয়ে উত্থাপিত বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে প্রায় পৌনে আট লাখ কোটি টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বেহাল জনসাধারণ, আর বিশ্ব অর্থনীতির টানাপড়েনে আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ আগ্রহী।
কভিড মহামারির চেয়েও ভয়াবহ আর্থিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মহামারি-উত্তর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর্যায়ে, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন অসম যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই সাইড মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকেও প্রভাবিত করছে। স্থানীয় বাজারে সব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন বিপর্যস্তপ্রায়।
কভিড মহামারি দ্বারা সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরবর্তী সময়ে পরবর্তী জাতীয় বাজেট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবে বলে আমরা আশাবাদী। পাশাপাশি সব সুবিধা সমভাবে সব নাগরিকের মধ্যে সুষমভাবে বিতরণ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত করবে। ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ (এসএমই) এবং কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি তৈরি করতে পারে। পরবর্তী জাতীয় বাজেটে এসএমই এবং অনানুষ্ঠানিক খাতকে বিকশিত করার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো উচিত, যা চাকরি সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি লক্ষ্যযুক্ত আর্থিক প্রণোদনা, কম খরচে অর্থায়নে অ্যাক্সেস এবং ছোট ব্যবসার জন্য সক্ষমতা-নির্মাণ কর্মসূচির মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে।
জাতীয় বাজেটে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (স্টেম) বিষয়গুলোয় মনোযোগ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। এটি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদার জন্য কর্মিবাহিনীকে প্রস্তুত করতে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সাহায্য করবে। আজকের দ্রুত বিকাশমান ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপে দেশের ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-গভর্ন্যান্স সার্ভিসগুলোকে সাপোর্ট করা পরবর্তী জাতীয় বাজেটের জন্য অপরিহার্য, যা পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি উন্নত করতে পারে এবং নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রচার এবং দেশীয় আইসিটি খাতের উন্নয়নে সহায়তা করা।
জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমিত করার জন্য, জাতীয় বাজেটে জলবায়ু সহনশীলতা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব উন্নয়নের জন্য আরও বরাদ্দ দেয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জিতে বিনিয়োগ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, এবং অরক্ষিত সম্প্রদায় এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য টেকসই অবকাঠামো।
এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোগগুলোকে অর্থায়নের জন্য পরবর্তী জাতীয় বাজেটে কর সংগ্রহ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে ফোকাস করা উচিত। কর সংস্কার, কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন এবং কর প্রশাসকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচির মাধ্যমে এটি অর্জন করা যেতে পারে।
বাজেটবিষয়ক কয়েকটি প্রস্তাব
ক. শিল্প পরিচালনার ব্যয় কমানোর জন্য আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার ধাপে কমিয়ে তিন শতাংশ করা উচিত। বর্তমানে অগ্রিম আয়করের হার শতাংশ। উল্লেখ্য, অগ্রিম আয়করের হার ৩০ জুন ২০১০ পর্যন্ত তিন শতাংশ ছিল; খ. জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে চার লাখ টাকা এবং নারী ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করা প্রয়োজন; গ. সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করার জন্য সকল উপজেলা পর্যায়ে আয়কর দপ্তর স্থাপন করা প্রয়োজন; ঘ. তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশন-ভিত্তিক উৎসে করের কার্যক্রম, আয়কর রিটার্ন দাখিল, অডিট নির্বাচন, কর নির্ধারণ, আপিল ও রিফান্ড প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা দরকার; ঙ. পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে আমদানিকৃত উপকরণের ক্ষেত্রে তিন শতাংশ আগাম কর (এটি) ধাপে ধাপে রহিত করা প্রয়োজন। কারণ এর ফলে শিল্প উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়; চ. নি¤œ আয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য পণ্য, সাধারণ পণ্য পরিবহন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিল্পের কাঁচামাল/উপকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রি-সাইক্লিং, টেন্ডারবহির্ভূত সরাসরি পণ্য মেরামত বা সার্ভিসিং খাত প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেয়া; ছ. বর্তমানে শুধু ভ্যাট নিবন্ধন ও ভ্যাট রিটার্নের ক্ষেত্রে অনলাইনে দাখিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নোটিশ প্রদান, অনলাইনে ডকুমেন্টেশন আদান-প্রদান, অডিট ও রিফান্ডসহ সব কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, রিফান্ড, অডিটসহ সব কার্যক্রম করার ক্ষেত্রে অটোমেশন প্রয়োজন। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে করদাতাদের ব্যবসা পরিচালনা করা অনেক সহজ হবে, তার সঙ্গে সঙ্গে মূসক কর্তৃপক্ষেরও করদাতাদের তদারকি করা অনেক সহজ হবে; জ. যন্ত্রপাতি, তালিকাভুক্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, মৌলিক এবং দেশে উৎপাদিত হয় না এমন কাঁচামালের আমদানি শুল্ক হার তিন শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা; ঝ. আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে আমদানি সীমাবদ্ধ করার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য বা সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (জবমঁষধঃড়ৎু উঁঃু) আরোপ করা উচিত।
গত ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে জাপান সফর করি। সেখানে বাংলাদেশ এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত হওয়ার পাশাপাশি জাপান বাজেট সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশকে ৩০ বিলিয়ন ইয়েন উন্নয়ন সহায়তা দেবে জাপান, আমাদের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারির প্রসারে যা একটি দৃষ্টান্ত।
পরবর্তী বাজেটের জন্য চারটি বড় চ্যালেঞ্জÑসুদের টাকা পরিশোধ, জনকল্যাণে বড় আকারের ভর্তুকি দেয়া, মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি। এছাড়া প্রতি বছরই রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে বছর শেষে ঘাটতি দেখা যায়। অথচ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আদায়ের মাধ্যমে অনেকখানি ঘাটতি সামাল দেয়া সক্ষম। তবে জিডিপির ঘাটতি পাঁচ শতাংশের মধ্যে থাকলে এটাকে বড় কোনো সমস্যা বলে প্রতীয়মান হয় না।
আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি হ্রাস করা, নীতিমালাকে ব্যবসাবান্ধব করা এবং ব্যবসার নিবন্ধন ও লাইসেন্সের জন্য একটি স্বচ্ছ ও দক্ষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং স্থানীয় ব্যবসার প্রবৃদ্ধিকেও উৎসাহিত করে। এছাড়া ব্যবসায়িক নিবন্ধন ও লাইসেন্সের জন্য সুবিন্যস্ত পদ্ধতি, অর্থায়ন ও ঋণের অ্যাক্সেস বৃদ্ধি করা উচিত। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বাজেট যে ব্যাপক এবং কার্যকর, তা নিশ্চিত করতে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে ব্যবসা সহজীকরণে সরকারকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে।
সভাপতি, বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার (বিএমসিসিআই); পরিচালক, এফবিসিসিআই; পরিচালক, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন; সিইও, মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আয়আল কর্প লিমিটেড