সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশে চলমান ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে কমেছে দেশের আমদানি-রপ্তানিবাহী পণ্য পরিবহন। আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে। ফলে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এতে বেসরকারি উদ্যোগে পরিবহন সেক্টরে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগের সেক্টরটিতে অনেকটা স্থবিরতা নেমে আসছে।
গাড়ি মালিক ও শ্রমিক সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্য পরিবহনের শতভাগ পুরোটাই পরিচালিত হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানিকৃত লাখ লাখ টন পণ্য দেশের নানা স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ টন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আইসিডি এবং বন্দরের অভ্যন্তরে আনার ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হয় ১০ হাজারের বেশি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং প্রাইমমুভার। এছাড়া সারাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে পণ্য পরিবহন খাতে ২৫ হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান এবং প্রাইমমুভার চলাচল করে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, নভেম্বর মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৬ লাখ ছয় হাজার ৭৭২ টিইইউএস। অপরদিকে ২০২১ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ টিইইউএস। এতে গত বছরের তুলনায় কমতে পারে কনটেইনার হ্যান্ডলিং। ফলে কমবে চট্টগ্রাম বন্দরের আয়। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণও কমবে। আর ২০২০ সালের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯২৭ টিইইউএস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্বের নানা দেশে সংকট তৈরি হয়েছে। আর দেশে প্রকট ডলার সংকট। এই সংকটের কারণে দেশের আমদানিপত্র খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে দেশের অর্থনীতিতে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যদি আমাদের এলসি খোলা স্বাভাবিক হয়, তাহলে সবকিছুর দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
গত কয়েক মাসে বন্দরের পণ্য পরিবহন গড়ে অন্তত ২৫ শতাংশ কমে গেছে। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের মতো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য নিয়ে চলাচল করত, তা এখন সাত হাজারের নিচে নেমে এসেছে। আর প্রয়োজনীয় পণ্য না থাকায় ভাড়ার পরিমাণ একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর এই ভাড়া দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে।
একাধিক পরিবহন ব্যবসায়ী বলেছেন, কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে একটি ট্রাক কিংবা কাভার্ডভ্যান ঢাকা যেত ২৫ হাজার টাকায়। যা ১৬ হাজার টাকা। একইভাবে বন্দর থেকে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, মাঝিরঘাট কিংবা সিটি গেট এলাকার লোকাল ভাড়া চার হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। বর্তমানে তা আড়াই হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রাইমমুভার ট্রেইলর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে দেড় হাজারের প্রায় প্রাইমমুভার চলাচল করে। প্রতিদিন বন্দর থেকে গড়ে পাঁচশ’র মতো প্রাইমমুভার বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করত। কিন্তু বর্তমানে তা দেড়শ থেকে দুইশতে নেমে এসেছে। অলস বসে আছে বহু প্রাইমমুভার। অথচ জ্বালানি খরচ এবং সেতু মাশুল বাড়ার পরও ভাড়া না বাড়ায় যেগুলো চলে সেগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। এভাবে কয়েক মাস চললে পুঁজি আর থাকবে না।
চট্টগ্রাম থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকায় গেলে ফিরতি পথে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য পণ্য পাওয়া যেত। এখন ডাউন ট্রিপ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণ শত শত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান অলস বসে আছে। যেগুলো পণ্য নিয়ে ঢাকা বা দূরে যাচ্ছে, সেগুলোও খুবই কম ভাড়ায় চলাচল করছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর যে পরিমাণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে, তাতে খরচ তোলাও অনেক সময় কঠিন হয়ে উঠছে। ফলে পণ্য পরিবহন সেক্টরে বিরাজিত বেহাল দশায় বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত টাকা খেলাপি হবে।