Print Date & Time : 20 August 2025 Wednesday 12:05 pm

বাড়তি দাম দিয়েও মিলছে না শিশুখাদ্য

বীর সাহাবী: দেশের বাজারে শিশুখাদ্যের দাম আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবুও দেশের বাজারে মিলছে না। শিশুখাদ্যের মধ্যে অন্যতম ল্যাকটোজেন, এনএএন, সেরেলাক, বায়োমিল, নিডো, এলডোবেবি এবং পেডিয়াশিওর দুধের দাম মাস কয়েকের ব্যবধানে কয়েক দফা বেড়েছে। এরপরও এসব ব্র্যান্ডের দুধ চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা।

রাজধানীর বেশকিছু বাজার ও অনলাইনে এসব ব্র্যান্ডের দুধ বিক্রি করে এমন অনেকগুলোর ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, বাজারের বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোয় দুধের মজুত কম। পাশাপাশি ওয়েবসাইটের মধ্যে অনেকগুলোয় দেখা গেছে এসব ব্র্যান্ডের দুধ স্টক আউট বা সোল্ড আউট হয়ে আছে। বিক্রেতারা বলছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই দুধ কিনতে পারছেন না। আর অভিভাবকদের অভিযোগ, তারা বেশি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী শিশুর জন্য দুধ কিনতে পারছেন না। অনলাইনে চড়া দামে অর্ডার দিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করেও মিলছে না দুধ।

দেখা গেছে, দুই থেকে তিন মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে শিশুখাদ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ল্যাকটোজেন-১, সেরেলাক, বায়োমিল-১, পেডিয়াশিওর এবং এনএএন-১ এর দাম প্যাকেট প্রতি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক পরিবার।

খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শান্তা-ইমন দম্পতির ৬ মাসের সন্তান জšে§র পর থেকে বুকের দুধ কম পাওয়ায় এনএএন-১ ফর্মুলা দুধ দেয়া হয় তাকে। এতে মাসে ৮ প্যাকেট এনএএন-১ কিনতেই পরিবারটির ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। দুই মাস আগেও এই খরচ ছিল ৮ হাজার টাকা। ইমন বলেন, ‘দুধের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে গেছি। যেখানে সন্তানের জীবনের প্রশ্ন; সেখানে তো আপস করা যায় না। অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই বাড়তি দাম দিয়ে দুধ কিনতে।’

অনলাইনে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দুধ বিক্রি করে এমন প্রতিষ্ঠান এনআরবি শপ সারাদেশে হোম ডেলিভারিও দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বলেন, ‘আমাদের এখানে আপাতত দুধ স্টক নেই। দুধের দাম কৌটাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে। তাহলে আমরা কিনবই কত দিয়ে আর বিক্রিই বা করব কত! তাই আপাতত আমাদের শপে দুধ নেই।’

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মাস দুয়েক আগে ৪০০ গ্রামের এনএএন-১ প্যাকেট ৯৮০ টাকা ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। বায়োমিল-১ এর দাম ৫০ টাকা বেড়ে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ল্যাকটোজেন-১ বিক্রি হচ্ছে ১০৫০ টাকায়। এছাড়া পেডিয়াশিওর ১৮৫০ টাকা এবং সেরেলাক বিক্রি হচ্ছে ১১৫০ টাকায়। ল্যাকটোজেন-১ এর দাম ভারতে বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ রুপিতে; যা বাংলাদেশি টাকায় ৫৮০ টাকা। এনএএন-১ বিক্রি হচ্ছে ৭৮৫ রুপি বা বাংলাদেশি ১০৩৯ টাকায়। পেডিয়াশিওর বিক্রি হচ্ছে ১২০০ রুপিতে; যা বাংলাদেশি টাকায় ১৫৮৭ টাকা। সেরেলাক বিক্রি হচ্ছে ৬৪৯ রুপিতে; যা বাংলাদেশি ৮৫৮ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। এই দাম দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বাংলাদেশে এই পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে দিতে হয় উচ্চ শুল্ক।

২০২১ সালের ১৭ জুন বাংলাদেশে শিশুখাদ্য পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফিলিং ও প্যাকেজিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি। দেশের শিশুখাদ্য পণ্যের বাজারে নিজেদের প্রভাব আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই বাংলাদেশে অত্যাধুনিক ‘ইনফ্যান্ট ফর্মুলা প্রসেসিং, ফিলিং ও প্যাকেজিং প্ল্যান্ট’ স্থাপন করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশে নেসলের পণ্যের দাম বেশির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নেসলে বাংলাদেশের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, লিগ্যাল ও রেগুলেটরি) দেবব্রত রায় চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নেসলে বাংলাদেশ কর্তৃক উৎপাদিত, আমদানিকৃত ও সরবরাহকৃত শিশুখাদ্যগুলোর বর্তমানে সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিনভাবে আমরা পণ্য সরবরাহ করে আসছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত ও বিপণনকৃত নেসলের পণ্যগুলোর দাম নির্ভর করে সেসব দেশের রাজস্ব বা কর ব্যবস্থাপনা বিপণন প্রক্রিয়া, উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল সংগ্রহের স্থান ইত্যাদির ওপর। বাংলাদেশের শিশুখাদ্যের বাজার আমদানিনির্ভর হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের পরিবর্তন, উচ্চ আমদানি শুল্ক (প্রায় ৫৬ শতাংশ), বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে সুদ ব্যয় ও মুদ্রার বিনিময় হারের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ও এর সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট খরচ বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের শিশুখাদ্যের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হতে পারে।’

নেসলের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, তাদের যে খুচরা মূল্য কোম্পানি কর্তৃক দেয়া হয়ে থাকে এর বাইরে বেশি রাখার সুযোগ নেই। নেসলে ল্যাকটোজেন-১ ৪০০ গ্রাম ওজনের টিনের কৌটা ৮৫০ টাকা, এনএএন-১ ১২৫০ টাকা এবং সেরেলাক-১ স্টেজ রাইস মিলক ৩৫০ গ্রাম বিআইবির মূল্য ৪০০ টাকা। তবে যেসব আমদানিকারক বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে নেসলের পণ্য এনে বিক্রি করেন, তারা বেশি দাম নিয়ে থাকতে পারেন। তবে নেসলের পণ্য বেশি দামে বিক্রির সুযোগ নেই বলে জানানো হয়।

বাংলাদেশে বেশি দামে বিক্রির কারণ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, বাজারে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে শিশুখাদ্যের বাজারেও তদারকি করা হচ্ছে। আমদানি মূল্য ও বিক্রয় মূল্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। অসংগতি পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

আমদানি-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলছেন, ডলার সংকট, পরিবহন খরচসহ নানা কারণে শিশুখাদ্যের দাম বেড়েছে। আগে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বহনে যে খরচ দেয়া লাগত, এখন সেই একই বা তার চেয়েও কম পণ্য পরিবহনে খরচ যাচ্ছে অনেক বেশি। পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে এলসি করছে না ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির (বিএসসিএমএস) সভাপতি নকীব খান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঘটছে। ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বাড়ছে। মূলত এসব কারণেই দাম বাড়ছে।’

অতি প্রয়োজন ছাড়া এসব পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর পক্ষে পুষ্টিবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘মায়ের দুধের পাশাপাশি, ৬ মাসের বেশি বয়সের শিশুদের বিকল্প খাবারে অভ্যস্ত করা প্রয়োজন।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় সব শ্রেণির ক্রেতার নাভিশ্বাস ওঠার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিছু যৌক্তিক কারণে বেড়েছে, আবার কিছু অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। কভিড পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি করা সব ধরনের পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে নাজেহাল করছে। এর মধ্যে শিশুখাদ্যের বাজার হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে হয়রানি করছে কি না, তা তদারকি সংস্থার খতিয়ে দেখতে হবে।’

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পুষ্টিকর কিছু খাবার খাওয়াতে হয়। এজন্য কিছু সাপ্লিমেন্টারি দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তাই শিশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি তৈরি হতে পারে।