এম.এ. শাহরিয়ার, বান্দরবান: জুমের আগুনে পুড়ছে বান্দরবানের সবুজ পাহাড়। জুমিয়াদের লাগানো আগুনে পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি। সবুজ পাহাড়গুলো হচ্ছে বৃক্ষশূন্য। আদিপদ্ধতিতে জুম চাষের জন্য পাহাড়ের ঝাড়-জঙ্গল, গাছপালায় আগুন লাগিয়ে পোড়ানোর কারণে ব্যক্তিমালিকানাধীন অসংখ্য মিশ্রফলের বাগানও পুড়ে যায় প্রতিবছর।
এদিকে জুমিয়াদের লাগানো আগুনে শুধুই পাহাড়ের গাছপালা, জীববৈচিত্র্যই পুড়ছে না, স্থানীয় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও মানুষ পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিগত ১৫ বছরে জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানছিসহ সাত উপজেলার পাহাড়ে লাগানো
জুমের আগুনে পুড়ে মারা গেছেন কমপক্ষে ১৪ মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা সদরে প্রশাসন পরিচালিত পর্যটন স্পট নীলাচল পাহাড়েও জুমিয়ারা জুম চাষের জন্য ঝাড়-জঙ্গল পোড়াতে আগুন লাগায়। এ আগুনে নীলাচল ট্যুরিস্ট স্পটের চারদিকের সবুজ পাহাড়ের গাছপালা, ঝাড়-জঙ্গলগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। জুমের আগুনে পুড়ে গেছে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিএনপি নেতা আবদুর রশীদসহ পার্শ্ববর্তী অনেকের মিশ্র ফলের বাগানও। এছাড়া বান্দরবান-রোয়াংছড়ি, রুমা-থানচি, বান্দরবান-রাঙামাটি, চিম্বুক-থানচি-জীবননগর, বগালেক-ক্যাওক্রাডং সড়কের দু’পাশেও অসংখ্য পাহাড় জুম চাষের জন্য আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হয়েছে।
জেলার থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বেশ কয়েকটি পাহাড় পোড়ানো হয়েছে। জুমের আগুনে সবুজ পাহাড়গুলো পোড়ানোর কারণে তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বান্দরবানে। আগুন লাাগিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিজসম্পদ। জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ে আগুন দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটি ক্ষয় ও প্রাণিজসম্পদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি বিভাগসহ নানা সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে এবারও বান্দরবানে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে জুম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলা সদরের নীলাচল, হাতিভাঙ্গা পাড়া, রামজাদীপাড়া, ডলুপাড়া, গেজমনিপাড়া, যৌথখামার এলাকা, কানাপাড়া, মেঘলা, মাঝেরপাড়া, আমতলীপাড়া, সাতকমলপাড়া, চিম্বুক পাহাড় এলাকা ও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর দু’পাশে শত শত পাহাড়ের ঝাড়-জঙ্গল, গাছপালা কেটে আগুন লাগিয়ে জুম চাষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
চিম্বুক সড়কের বাসিন্দা লারেং লিয়ান মুরুং ও রোয়াংছড়ির বাসিন্দা চাথুয়াই মারমাসহ কয়েকজন জানান, পাহাড়ে জুম চাষ করা তাদের পূর্বপুরুষের আদি পেশা। জুমে
পাহাড়ি ধান, ভুট্টা, মরিচ, যব-সরষে, মিষ্টিকুমড়া, মারমা, টকপাতা ও আদাসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করেন তারা। জুম চাষ আগের মতো লাভজনক নয়; কিন্তু বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় তারা জুম চাষ ছাড়তে পারছেন না।
মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ , বান্দরবানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, জুম চাষ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জুমিয়াদের লাগানো আগুনে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য, সবুজ গাছপালা ও বন্যপ্রাণী পুড়ে মারা যায়। ফলে মাটি ক্ষয় হয়ে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করলে এসব সমস্যার সমাধান হতো।
লেখক ও গবেষক সিংইয়ং ম্রো বলেন, জুম চাষের পরিমাণ আগের তুলনায় কমেছে। ইদানীং মিশ্র ফল চাষের দিকে ঝুঁকছে তারা। তবে অবহেলিত ম্রো জনগোষ্ঠী এখনও সম্পূর্ণ জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুম চাষের মাধ্যমে জুুমিয়া পরিবারগুলো সারা বছরের খাদ্য সংগ্রহ করলেও এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐহিত্য-সংস্কৃতির একটি অংশ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. একেএম নাজমুল হক বলেন, জুম চাষ পাহাড়িদের সিংহভাগ খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। জুম চাষ থেকে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। তবে প্রকৃতিগতভাবে জুম চাষ ক্ষতিকারক হওয়ায় আধুনিক ও টেকসই পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষাবাদে জুমিয়াদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।