বায়ুদূষণের কবলে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি

ইয়াসমীন রীমা: হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে হাতাশায় ভেঙে পড়লেন মাসুমা আখতার। একমাত্র পুত্র নাহিনের জন্য ডাক্তার তেমন কোনো জরুরি ওষুধ দিলেন না, শুধু বললেন সাবধানে থাকতে আর ধুলাবালি থেকে মুক্ত রাখতে। অথচ মাসুমা কত যতেœ ছেলেকে মানুষ করছেন, তা তো ডাক্তার জানেন না। কেমন করে নাহিন অ্যাজমায় আক্রান্ত হলো বুঝতে পারেন না মাসুমা। ক্লাস থ্রিতে পড়া নাহিন বরাবরই বাসায়ই তো থাকে, ধুলাবালিতে যায় কখন ভাবেন মাসুমা। সকালে স্কুলে মাসুমা নিজেই নিয়ে যান। ছুটির পর নাহিনকে মাসুমাই নিয়ে আসেন। কালেভদ্রে আবাসিক এলাকার মাঠে খেলতে যায় বিকালে, তবে রোজ দিন নয়। অথচ ডাক্তার বললেন, অতিরিক্ত ধুলাবালি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে নাহিন ধীরে ধীরে অ্যাজমাটিক ডিজিজে ভুগছে। কী করবেন মাসুমা ভেবে পান না! নাহিনের বাবা প্রবাসী রুকনউদ্দিন আহমেদকে এ ব্যাপারে জানালে তিনিও মাসুমাকে কতক্ষণ বকাঝকা করলেন। ছেলের এ অবস্থার জন্য। মাসুমার মেঝো ভাই কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির মাসুমাকে প্রবোধ দেন আসলে আমাদের দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা অতিরিক্ত। সে কারণে অনেক মানুষ বায়ুদূষণে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, বলাবাহুল্য, এর ভেতর শিশুদের হার সবচেয়ে বেশি। এক বছরের কমবয়সী প্রায় ১৭ মিলিয়ন শিশু এমন এলাকাগুলোতে বসবাস করে, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমার চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি। যার ফলে তাদের বিষাক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে হয়, যা মস্তিষ্কের বিকাশকে ঝুঁকিতে ফেলে। এসব শিশুর তিন-চতুর্থাংশের বেশি দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে।

শুধু নাহিন নয়, দেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে অনেক মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ রোগে। জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ ঝুঁকির সম্মুখীন। এ প্রতিবেদনে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বাস করা শিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইউনিসেফের মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা এপিকে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের জলোচ্ছ্বাস বন্যা, খরা, নদীভাঙনের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু বড় শহরগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে তারা সেখানে সব ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদুার বলেন, বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে আবহাওয়াজনিত ও ভৌগোলিক কারণ উল্লেখযোগ্য। মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে ইটভাটা ও শিল্পকারখানা, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষক এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে বায়ুদূষণ হয়। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার আশপাশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইটভাটার কারণে ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। ভরা মৌসুমে ইটভাটা দৈনিক প্রায় ১০ টন কয়লা পোড়ায়। এক টন কয়লা পোড়ানোর ফলে ২ দশমিক ৮ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে (অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ ও বস্তুকণা ১০), সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ডাই অক্সিন ও ফুরান নিঃসরিত হয়।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিভাবকরা যত শিশুকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের ৪৯ শতাংশ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। বর্ষা মৌসুমে শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুদের হার ৩৫ শতাংশ নেমে আসে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল ঢাকা জেলার ১১টি এলাকায় গবেষণা করে পেয়েছে ফুসফুসের অসুস্থতা ক্রমেই ব্যাপক হচ্ছে। ফুসফুসের সক্রিয়তা বা পিএফটি (প্যালমোনারি ফাংশন) পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ২৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ মানুষের ফুসফুস কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশি। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য এবং নিš§ ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দারা বায়ুদূষণের প্রধান শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, পিএম ২.৫ এর নিরাপদ কিংবা সহনীয় মাত্রা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হƒদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। পিএম ২.৫ এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে।

বায়ুদূষণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, পূর্বে কার্বন মনো-অক্সাইডসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যেত দূষিত বায়ুতে। এর সাথে ভাসমান ধূলিকণা প্রচুর পরিমাণ বেড়েছে এবং বেড়েছে ভাসমান প্লাস্টিক কণা। বেড়ে গেছে সীসাসহ নানা ক্ষতিকর উপাদানও। আমাদের দেশের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হলো শহরের চলমান মেগা প্রজেক্ট থেকে নিঃসরিত ধুলোবালি। এসাথে যোগ হয়েছে গাড়ির ধোঁয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে জেনারেটরের ধোঁয়া। শহরের চারপাশের যেসব ইটভাটা রয়েছে, সেগুলোর কারণে ৫৬ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।

বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এ সময় জন্ম নেয়া শিশুদের গড় আয়ু কমবে ২০ মাস।

এ ব্যাপারে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে সব বয়সের মানুষেরই সমস্যা হয়। তবে শিশুদের বেশি সমস্যা হয়। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় শারীরিকভাবেও শিশুদের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হতে হয়। দূষিত বায়ুতে যে সিসা থাকে, তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশও। বাংলাদেশের বায়ুদূষণের জন্য দায়ী বিভিন্ন যানবাহনের ধোঁয়াসহ চারপাশে থাকা ইটভাটার ধোঁয়া কলকারখানা থেকে বের হওয়া বিভিন্ন রাসায়নিক ধোঁয়া। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারের দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সবার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া বায়ুদূষণের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সিসা প্রভৃতির মাত্রা বেড়ে যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণার পরিমাণও বাতাসে অনেক বেশি। দূষিত বায়ুতে থাকা সিসা মারাত্মকভাবে লিভার, কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপরও। এই সিসার কারণে শিশুদের মানসিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি শারীরিক বৃদ্ধির হারও কমে যেতে পারে। গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে এই সিসার কারণে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, বায়ুদূষণ দিন দিন বাড়ছে। তাই এই মুহূর্তে যদি দূষণ রোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া না হয়, তবে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজš§কে বায়ুদূষণের কারণে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। বায়ুদূষণ মোকাবিলা করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন ধরনের দূষণ বুঝতে হবে, আমাদের সচেতনতা স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে প্রভাবিত করবে, আমাদের চারপাশের বাতাসকে পরিচ্ছন্ন হতে সহায়তা করবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের পেশা ও পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মাহমুদ হোসেন ফারুকী বলেন, ‘চার পাশের ইটভাটা, নির্মাণকাজ থেকে আসা ধুলা ও পরিবহন থেকে বের হওয়া ধোঁয়া মিলে বাতাসের মধ্যে একধরনের দূষিত মিশ্রণ তৈরি করে, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে গিয়ে মারাত্মক সব রোগবালাই তৈরি করছে। নিঃশ্বাসজনিত সমস্যা, হƒদরোগ ও নানা ধরনের স্নায়ুবিক রোগ তৈরি করছে, যা একটি কম বুদ্ধিসম্পন্ন রোগাক্রান্ত ও দুর্বল নতুন প্রজš§ তৈরি করছে। এভাবে চলতে থাকলে এ শহরে সুস্থ মানুষ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বায়ুদূষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা গেলে শুধু শিশুদের উপকার নয়, সমাজেরও স্বাস্থ্যসেবা খরচ সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর উপকারিতা পাওয়া যায়। ফলে প্রত্যেকের জন্য একটি নিরাপদ-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকি বিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’র এক প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে বাংলাদেশের বায়ুর মান। এ অবস্থায় বায়ুদূষণের কারণে নানাবিধ রোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকটভাবে।

স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে মানুষের শরীরে দূষিত বাতাসের প্রভাবে যে বিষক্রিয়া হয়, তাতে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ে যায় এবং গর্ভস্থ শিশুর বিকলাঙ্গতাও বেড়ে যায়। এ কারণে সার্বিকভাবে আমাদের মতো দেশের মানুষের গড় আয়ু সাত বছরের মতো কমে যায়। একইভাবে বায়ুদূষণের কারণে আমাদের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, জাতীয়ভাবে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা এবং অর্থ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। তার মধ্যে আছে, দেশের কোনো কোনো এলাকার বাতাস সবচেয়ে দূষিত এবং এই দূষণের উৎস কী, সেটা চিহ্নিত করে তা কমানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা দেয়া, সার্বক্ষণিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করার আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপযুক্ত স্থানে পর্যাপ্ত ‘কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন’ (সিএএমএস) স্থাপন করাসহ, একইসঙ্গে বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে জনগণকে রক্ষায় সতর্কতামূলক সংকেত পদ্ধতি চালু করা। এছাড়া পোড়ানো ইটের বিকল্প পদ্ধতি উন্নয়নের জন্য ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে উচ্চ আদালত থেকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো সুচারুরূপে পালিত হবে এবং পরিবেশদূষণ রোধে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে, এটাই প্রত্যাশা। সম্মিলিত প্রয়াস এবং সচেতনতা নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে সাহায্য করবে নিশ্চয়ই। গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করলে মানুষের সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুস্থ প্রজš§ এবং জাতি এবং নির্মল পরিবেশ নিশ্চিতে বায়ুদূষণ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন শুধু সমন্বিত উদ্যোগ এবং আমাদের এগিয়ে আসা।

পিআইডি নিবন্ধ