ঝুঁকিতে অ্যাসাইকুডা সিস্টেম

বারবার আইডি-পাসওয়ার্ড চুরি খোঁজ মেলে না দোষীদের

রহমত রহমান: সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে। সেই আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে এজেন্ট প্রতিনিধি প্রবেশ করলেন অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে। তাতে আপলোড করলেন নিজেদের (সিঅ্যান্ডএফ) তৈরি করা রিপোর্ট। যার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বের করতে চাইলেন ৯ কনটেইনার পণ্য। কিন্তু শেষ অবধি রক্ষা হয়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আরাগ ট্রেডিং কোং লিমিটেড নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি মো. বজলুর রহমান নামে একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে পরীক্ষণ রিপোর্ট আপলোড করেছেন। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা প্রতিটি কাস্টম হাউসের নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। কিন্তু অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড হ্যাক বা জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই।

২০ মে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মোহাম্মদ জাকারিয়া কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওইদিন রাত ১১টা ৩৩ মিনিটে অ্যাসাইকুডায় এই কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করেন শেখ সেজান নামে এক ব্যক্তি। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ওই অনুপ্রবেশকারী আবার লগইন করে ভুয়া ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি করা ছয় কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট খালাসের শুল্ক প্রক্রিয়া শেষ করেন। হ্যামকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হ্যামকো করপোরেশন লিমিটেড ওয়াটার পিউরিফাইয়ার মেশিন ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাস্টম হাউস ও কাস্টম গোয়েন্দা জানতে পেরে সিগারেটের চালানটি আটক করে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে মোহাম্মদ জাকারিয়ার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার নিয়ে। এই সিস্টেমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মকর্তার মোবাইলে ওটিপি যাওয়ার কথা। কিন্তু সিস্টেমের দুটি স্তর থেকে ওটিপি আসেনি। একই ঘটনা ঘটেছে সুপ্রিম স্মার্টওয়্যার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। কাপড় ঘোষণা দিলেও চালানটিতে মদ পাওয়া যায়।

অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে এর আগেও বহুবার আইডি ও পাসওয়ার্ড জালিয়াতি বা হ্যাক করে বহু পণ্য খালাস নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারও একই অভিযোগ উঠল। তবে গত বেশ কয়েকবার সিকিউরিটির লেয়ার খ্যাত ওটিপি পর্যন্ত জালিয়াতি হয়েছে। বারবার জালিয়াতি বা হ্যাক হলেও অ্যাসাইকুডার নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি কাজ করা হয় না। কমিটি গঠন করা হলেও দোষীদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এনবিআর বলছে, দোষীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এনবিআর সূত্রমতে, অ্যাসাইকুডায় জালিয়াতির মাধ্যমে পণ্য খালাসের অপচেষ্টার তদন্ত করতে ২২ অক্টোবর এনবিআর সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এতে এনবিআর সদস্য (কাস্টমস: রপ্তানি, বন্ড ও আইটি) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে আহ্বায়ক ও দ্বিতীয় সচিব (কাস্টমস অটোমেশন) মো. আবদুল কাইয়ুমকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটিকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কমিটিকে ইতোপূর্বে ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি বা হ্যাক করে খালাস করা বা খালাসের চেষ্টা করা ১৬টি বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট তদন্ত করতে বলা হয়েছে। এছাড়া অ্যাসাইকুডায় জালিয়াতিতে ১১ ধরনের অপরাধ তদন্ত করতে কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কাস্টমস গোয়েন্দার মহাপরিচালকের নেতৃতে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
একাধিক সূত্রমতে, ২০ মে উপকমিশনার মোহাম্মদ জাকিয়ার ইউজার ও আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এক কনটেইনার সিগারেট বের করার চেষ্টা করা হয়। তবে এই কনটেইনার গত ৯ মাস আগে বন্দরে আসে। লগইন করার সময় এই কর্মকর্তার মোবাইলে ওটিপি না আসায় সিস্টেমের দুর্বলতা সামনে এসেছে। একইভাবে সুপ্রিম স্মার্ট ওয়্যারের চালানটি ২১ মে একই কর্মকর্তার আইডি হতে ‘গুড এক্সিট ফর্ম কাস্টমস এরিয়া’ বলে সম্পাদন করা হয়। অথচ এই পদবির কর্মকর্তার আইডি থেকে গেট এক্সিট করার কথা নয়। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া রপ্তানি দেখানো হয়েছে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে। সিস্টেমে কর্মকর্তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করে রপ্তানি দেখানো হয়েছে। আইডি ও পাসওয়ার্ড কীভাবে নেয়া হলো, কীভাবে অ্যাসাইকুডাতে প্রবেশ করেছেÑতা নিয়েও তদন্ত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, রাজস্ব কর্মকর্তা ডিএএম মুহিবুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি তিনটি দপ্তর ঘুরে যশোর ভ্যাট থেকে ২০১৫ সালে অবসরে যান। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত অবস্থায় তিনি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ইউজার আইডি-পাসওয়ার্ড নেন। কিন্তু বদলি হওয়ার পর ২০১৮ পর্যন্ত আইডি সচল এবং ওই আইডি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ চালান খালাস নেয়া হয়েছে। ফজলুল হক নামে আরেকজন কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার চালান খালাস নেয়া হয়েছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এ আইডি ব্যবহার করা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের মিথ্যা ঘোষণার স্থগিত করা চালান কীভাবে খালাস নেয়া হয়েছে, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ২০১৯ সালে কাস্টমস গোয়েন্দা এ চমকপ্রদ ও ভয়াবহ জালিয়াতি উদ্ঘাটন করে। সে সময় এনবিআরকে প্রতিবেদন দেয়া হলে নড়েচড়ে বসে। এরপর মৃত কর্মকর্তার নামের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে প্রবেশ করে জালিয়াত চক্র।

একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, অ্যাসাইকুডা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার। এতবার হ্যাক, জালিয়াতির ঘটনা ঘটার পরও এনবিআর খুব বেশি পদক্ষেপ নেয় না। এবার ওটিপি পর্যন্ত জালিয়াতি করেছে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি আপডেট হচ্ছে, হ্যাকার ও জালিয়াত চক্র বাড়ছে। এনবিআর আলাদা একটি উইং করে অ্যাসাইকুডার নিরাপত্তা না দিলে এনবিআর, ব্যবসায়ী তথা দেশ ক্ষতির মুখে পড়বে।
অপরদিকে, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে জালিয়াতিতে একটি অসাধু চক্র জড়িত বলে জানিয়েছেন এনবিআরের মুখপাত্র সৈয়দ এ মু’মেন। তিনি বলেন, চক্রটি ২০ মে একজন কর্মকর্তার আইডিতে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে এক কনটেইনার সিগারেট খালাস করে। হ্যামকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের পানির ফিল্ডার ঘোষণায় এই সিগারেট আমদানি করে খালাস নেয়া হয়েছে। এতে অ্যাসাইকুডা সিস্টেম হ্যাক করে নয়, বরং কর্মকর্তার অবর্তমানে তার কম্পিউটার হতে তার আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে তা ব্যবহারের মাধ্যমে এই মালামাল খালাস করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর বিষয় বলছে এনবিআর। সেজন্য এ অপকর্মে জড়িত প্রকৃত দোষী এবং তার সহযোগীদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। দুটি কমিটি কাজ করছে। এ কাজে বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রয়োজনীয় সহায়তা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে গৃহীত কার্যক্রমগুলোর ফলে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম অধিকতর নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে বলে এনবিআর মনে করে।