নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের তিন ভাগের একভাগই উৎপাদন হয় পাবনায়। তাই পেঁয়াজে দেশীয় অর্থনীতিতে পাবনার অবদান ব্যাপক। নতুন জাতের পেঁয়াজ চাষে তুলনামূলক কম খরচে সাড়ে তিনগুণ বেশি ফলন হয়। ফলে এবার সংকটেও আশার গল্প রচনা করছেন পাবনার চাষিরা। বারি-৫ নামক নতুন জাতের এই পেঁয়াজ নিয়ে আশাবাদী কৃষি বিভাগও।
চাষি ও কৃষি বিভাগ বলছে, সাধারণত গ্রীষ্মকালে দেশের বাজারে পেঁয়াজের সংকট তৈরি হয়। কারণ এ সময় চাষিদের হাতে কোনো পেঁয়াজ থাকে না। অন্যদিকে এর আগে অল্প দামে চাষিদের থেকে পেঁয়াজ কিনে মজুত রাখে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে সংকটকালে পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি শুরু হয়। এ সময়ে কোনো পেঁয়াজ চাষও হয় না। এসব বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের আওতায় বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র বারি-৫ নামে একটি জাতের পেঁয়াজ উদ্ভাবন করে। যেটি আবাদে মুড়িকাটা বা চারা পেঁয়াজের তুলনায় ব্যয় তুলনামূলক কম। কিন্তু ফলন কয়েকগুণ বেশি। মাত্র ৩০ হাজার টাকা খরচে প্রতি বিঘায় ফলন ১৫০ থেকে ২০০ মণও হয়ে থাকে। প্রতিটি পেঁয়াজ ওজনে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। কম খরচে নতুন জাতের উচ্চ ফলনের পেঁয়াজ চাষে লাভের সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেশি। তাই এ পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন চাষিরা।
এ ব্যাপারে ঈশ্বরদীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, ‘কয়েক বিঘা জমিতে এবার আমি এ পেঁয়াজ আবাদ করেছি। একেকটি পেঁয়াজের ওজন ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হবে। এরই মধ্যে ২০০ গ্রাম অতিক্রম করেছে। বিঘায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলন হবে ২০০ মণের মতো; যা সাধারণত ১ একর জমিতেও সম্ভব নয়। এদিক থেকে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি করলেও খরচ বাদে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। এ পেঁয়াজ নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। এটি আমাদের জন্য লাভজনক একটি ফসল।’
চাষের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ পেঁয়াজ চাষে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। এ পেঁয়াজ আবাদে সার বা রাসায়নিকের পরিমাণ খুবই কম লাগে। তবে একদমই পানি সহ্য করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে জমি অবশ্যই উঁচু হতে হবে। কোনোভাবে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থাকলে মাঝে নালা কেটে পানি গড়িয়ে পড়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। একইসঙ্গে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই এ পেঁয়াজ আবাদ সম্ভব।’
চাষি শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘চাষে খুব বেশি জটিলতা নেই, খরচও কম। এর বিপরীতে ফলন ব্যাপক। প্রতি বিঘায় আমার ফলন হবে দেড়শ’ থেকে ১৬০ মণের মতো। অন্য পেঁয়াজে খরচ তোলা বা লাভ নিয়ে যে আশঙ্কা থাকে; সেটি এ ক্ষেত্রে একদমই নেই। তবে বীজ নিয়ে একটু জটিলতা আছে। এর বীজ এখনও চাষিরা উৎপাদন শুরু করেননি। বীজ উৎপাদনে কিছুটা হিসাব-নিকাশের ব্যাপার আছে। এটি কাটাতে পারলে উঁচু সব জমিতে চাষ করা যাবে। এতে যে সময়ে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়; সে সময়টা এ পেঁয়াজ দিয়ে মেটানো যাবে।’
সদর উপজেলার আতাইকুলা মধুরপুরের চাষি মকবুল হোসেন বলেন, ‘যে হারে ফলন হচ্ছে, তাতে লোকসান তো দূরে থাক; লাভ নিয়েও চিন্তার কিছু দেখছি না। মুড়িকাটা পেঁয়াজে খরচ ওঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা। কারণ দাম খুবই কম। কিন্তু এ পেঁয়াজে সে ভয় নেই। মার না খেলে আবাদ ২০০ মণের জায়গায় এক-দেড়শ’ মণ হবেই। সেদিক থেকে দাম আরও কম হলেও লাভবান হবো আমরা।’
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলার ৯টি উপজেলায়ই কম-বেশি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের নতুন জাত বরি-৫-এর আবাদ হয়েছে। তবে বেশি হয়েছে সদর, ঈশ্বরদী, সাঁথিয়া, সুজানগর, চাটমোহর ও আটঘরিয়া উপজেলায়। জেলায় এবার প্রায় ৭০ হেক্টর জমিতে এ পেঁয়াজের আবাদ করেছেন চাষিরা। বিঘায় ১৫০ মণ ফলন ধরলেও এ থেকে প্রায় ৮০ হাজার মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হবে।’
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দীন বলেন, ‘জেলায় এ পেঁয়াজের আবাদ ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যাসহ সব বিষয়ে চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন মাঠকর্মীরা। যে হারে ফলন হচ্ছে; তাতে গ্রীষ্মকালে বাজারে পেঁয়াজের সংকট মেটানো সম্ভব। এ ছাড়া উচ্চ ফলনে কৃষকেরা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন। তবে এ পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ও পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপনে কৃষকদের সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।’ এ কৃষি বিপ্লব পরিদর্শন করেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। পরিদর্শন শেষে উপ-সচিব কামরুল হাসান বলেন, ‘বারি-৫ পেঁয়াজে এখানকার চাষিদের সফলতা উল্লেখ করার মতো। সেটি দেখতেই এখানে এসেছিলাম। এ পেঁয়াজ চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এর বীজ উৎপাদন এখনো চাষিদের হাতে দেয়া সম্ভব হয়নি। এটি সম্ভব না হলে জনপ্রিয়তা হারাবে। বীজ উৎপাদনে পলিনেট হাউজসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত পদ্ধতির প্রয়োজন হচ্ছে। এ ব্যাপারে কীভাবে সহযোগিতা দেয়া যায়; সেটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলব।’