বিএটিতে শ্রমিকের শ্রম আছে, অধিকার নেই

রহমত রহমান: শ্রমিকদের তামাক প্রক্রিয়াকরণের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকির কাজ করানো হয়। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। দেয়া হয় না অন্যান্য ছুটি। নাইট শিফটের পর ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ইভিনিং শিফট করতে বাধ্য করা হয়। দেয়া হয় না নিয়োগপত্র। আইডি কার্ডের ইস্যুকারী একজন হলেও, নিয়োগকর্তা অন্যজন। শাস্তি বা চাকরিচ্যুতে শ্রম আইন মানা হয় না। শ্রমিক রেজিস্টার নেই। সার্ভিস বুক সংরক্ষণ করা হয় না।

দুর্ঘটনা বা পেশাগত জটিল ব্যাধি হলেও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। শ্রম আইন অনুযায়ী দেয়া হয় না প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিলের মুনাফা। শ্রমিকের নমিনি রাখার ব্যবস্থা নেই। গ্রুপ বিমার আওতায় আনা হয় না। প্রতিবছর টার্মিনেট করা হয়। স্থায়ী শ্রমিকদের কাজ মৌসুমি শ্রমিকদের দিয়ে করানো হলেও, শ্রম আইন অনুযায়ী সুবিধা দেয়া হয় না।

বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটি) বিরুদ্ধে তদন্ত করে শ্রম আইন লঙ্ঘনের এমন ২২টি অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। শুধু শ্রম আইন লঙ্ঘন নয়, বিএটির কুষ্টিয়া মেহেরপুরে সাতটি তামাক প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে ছয়টি কারখানার এই অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নেয়া হয়নি। কারখানায় নেই শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ। কারখানা পরিদর্শন, কাগজপত্র যাচাই ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত পৃথক দুটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএটি শ্রম আইন না মেনে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে দেশে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নিলে শ্রমিকরা সুবিধা পাবেন।

সূত্রমতে, বিএটির কুষ্টিয়া লিফ ফ্যাক্টরিতে মৌসুমি শ্রমিকদের শ্রম আইন না মেনে হয়রানি, চাকরিচ্যুত, সুবিধা না দেয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে শ্রমিকরা চলতি বছরের আগস্টে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগটি তদন্ত করে গত সেপ্টেম্বর মাসে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক দুটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত কমিটি বিএটির কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে সাতটি কারখানা পরিদর্শন ও তদন্ত করেছে। এতে কুষ্টিয়া (জিএলটি) ছাড়া বাকি ছয়টি কারখানা অনুমোদন নেই বলে তথ্য পেয়েছে।

পরিদর্শন পরিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, বিএটির কারখানায় টিএসটি মেকানিক্যাল, টিএসটি ইলেকট্রিক্যাল, কোয়ালিটি, বয়লার নামে শ্রমিকের পদ রয়েছে। যাদের বিএটির ভাষায় ‘পারমানেন্ট এমপ্লয়ি’। ক্যাটেগরি অনুযায়ী, এসব শ্রমিকের কেউ অফিস ম্যানেজমেন্টের কাজ করেন। আবার কেউ কারখানার মেশিন মেইনটেন্যান্সের কাজ করেন। তবে এদের কেউ তামাক উৎপাদনের কাজের সঙ্গে জড়িত নন। আবার বশিরুল আলম চাঁদ নামের একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে ‘মেইনটেন্যান্স ক্রু’ হিসেবে মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। যাদের দিয়ে ‘পারমানেন্ট এমপ্লয়ি’-এর মতো মেশিন মেইনটেন্যান্সের কাজ করানো হয়। আবার এমএসএম লজিস্টিক নামে ঠিকাদারি প্রতি¯¤ান থেকে পুরো বছর কারখানায় কাজ করার জন্য ৫৮ জন মৌসুমি শ্রমিক নেয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছেনÑঅফিস স্টাফ, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল। অথচ মৌসুমি এসব শ্রমিককে শ্রম আইন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না।

তামাক মেশিনে দেয়ার জন্য অর্থাৎ ফিডিং পদে বিএটি সরাসরি কোনো জনবল নিয়োগ দেয়নি। এমনকি ঠিকাদারের মাধ্যমেও এ পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে মেসার্স শিহাব উদ্দিন নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেজিপ্রতি চুক্তিতে কাজ করাচ্ছে বিএটি। একইভাবে হাউস কিপিং, পিকিং, এসপিএ, ক্লিনিং (বাথরুম, টয়লেট) পদেও কর্তৃপক্ষ সরাসরি বা ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করেনি। তবে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কারখানায় জনবল সরবরাহ না করে সরাসরি কারখানা প্রিমিসেসের ভেতর তামাক প্রক্রিয়াকরণ বা উৎপাদন করছে। মৌসুমি শ্রমিকদের হয়রানি, চাকরিচ্যুত ও শ্রম আইন না মানার ২২টি অভিযোগের প্রমাণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি মৌসুমি শ্রমিকদের উত্থাপিত ২২টি অভিযোগ তদন্ত করেছে।

বলা হয়েছে, স্থায়ী শ্রমিকরা যেসব সেকশনে কাজ করেন, সেসব সেকশনে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছে বিএটি। মূলত ২০১২ ও ২০১৩ সালের পরবর্তী সময় থেকে বছর বছর মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে মৌসুমি শ্রমিকদের এক নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর শ্রমিকদের টার্মিনেশন বা চাকরিচ্যুতি শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে আসছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, মৌসুমি শ্রমিকদের টার্মিনেশন করার সুযোগ নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর নতুন নিয়োগপত্র প্রদান ও প্রতি বছর বছর টার্মিনেশন শ্রম আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অভিযোগ উঠেছেÑকারখানা কর্তৃপক্ষ বিধি অনুযায়ী এক নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে। স্থায়ী শ্রমিকদের এক নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়।

কিন্তু মৌসুমি শ্রমিকদের প্রতি বছর বছর নতুন নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, বিএটি ২০১২ সাল থেকে নিয়োগ দেয়া মৌসুমি শ্রমিকদের একটি নিয়োগপত্র প্রদান করেছে। ২০১৫ সালে এসে তাদের টার্মিনেশন শুরু করে। মৌসুমি শ্রমিকদের ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ করে চার মাস স্থায়ী শ্রমিকদের মতো সব ধরনের কাজ করানো হয়, বাকি সময় বেকার। তবে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কিছু কিছু মৌসুমি শ্রমিক ১২ মাস করে থাকেন। শ্রম আইন অনুযায়ী এসব মৌসুমি শ্রমিককে স্থায়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। অথচ স্থায়ী শ্রমিকরা যেসব কাজ করেনÑমৌসুমি শ্রমিকদের দিয়েও একই কাজ করানো হয়। শ্রমিকদের আইডি কার্ডের ইস্যুকারী একজন, নিয়োগ কর্তা অন্যজন এবং বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আইডি কার্ড দেয়ার যে অভিযোগ শ্রমিকরা করেছেনÑতদন্তে তার সত্যতা পাওয়া গেছে। এছাড়া বিএটি শ্রম আইনের ফরম (৬) অনুযায়ী আইডি কার্ড দেয় না। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক রেজিস্টার নেই, সার্ভিস বুক সংরক্ষণ করা হয় না। নিয়োগপত্র, সার্ভিস বুক, পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত কোনো রেজিস্টার নেই।


আরও বলা হয়েছে, শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তারা কারখানা গিয়েছেন, সেদিন ছুটির দিন ছিল। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এই মৌসুমের শুরু থেকে কাজ করলেও কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পাননি। কারখানা কর্তৃপক্ষ যে ‘মান্থলি অ্যাটেনডেন্স ডিটেইল’ সংরক্ষণ করে, সেখানে সাপ্তাহিক ছুটি (রেস্ট ডে) রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ ছুটি শ্রমিকদের দেয় না বিএটি। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করানো হলেও, শ্রম আইনের ধারা ১০৪ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণমূলক সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। এ ধরনের কোনো ডকুমেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি। শুধু সাপ্তাহিক ছুটি নয়Ñনৈমিত্তিক ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, উৎসব ছুটিও দেয় না বিএটির কারখানা কর্তৃপক্ষ। নাইট শিফটের পর ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ইভিনিং শিফট করাতে বাধ্য করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। যদিও শ্রম আইনে নাইট শিফটের পর ২৪ ঘণ্টা বিশ্রামের নিয়ম আছে।

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নাইট শিফট শেষ হওয়ার পর ১২ ঘণ্টা, ৮ ঘণ্টাÑএমনকি কখনও কখনও ১ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্য আরেকটি শিফট করানো হয়। মহিদুল নামে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, তিনি টানা ১৬ বছর চাকরি করছেন। তাকে একটি শিফট শেষ হওয়ার পর কখনও কখনও ১ ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি শিফট করানো হয়। শ্রমিকদের শাস্তি বা চাকরিচ্যুত করতে শ্রম আইন মানা হয় না। চাকরিচ্যুত করা হলেও সব পাওনা পরিশোধ করা হয় না। বরখাস্ত হওয়া পাঁচজন শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএটিতে শ্রমিকদের প্রচলিত ও শ্রম আইন অনুযায়ী সুবিধা যেমনÑপ্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও মুনাফা প্রদান করা হয় না। যদিও কোম্পানিতে চাকরি শেষে এসব সুবিধা প্রদান করা হয়। তবে একই সালে যোগদান করা, একই কাজে নিয়োজিত, একই পদবির দুজন শ্রমিকের মধ্যে একজনকে স্থায়ী করা হয়েছে। আর অন্যজনকে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করাচ্ছে বিএটি। স্থায়ী শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিলের মুনাফার সুবিধাভোগী হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী মোট বেতনের ৫০ শতাংশ বেসিক হলেও তা দেয়া হয় না। শ্রম আইনে দুর্ঘটনাজনিত বা পেশাগত ব্যাধির কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। তামাকের ধূলিকণার কারণে দীর্ঘদিন শ্রমিকদের শরীরে প্রবেশ করে সিওপিডির মতো জটিল রোগ হচ্ছে। মৌসুমি শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী নমিনি রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

শ্রমিকদের গ্রুপ বিমায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। মৌসুমি সব শ্রমিককে কলআপ নোটিশ দেয়া হয় না। মৌসুমি শ্রমিকদের মতামত না নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা কতিপয় শ্রমিক বা ব্যক্তিকে সুযোগ দিয়ে মৌসুমি শ্রমিকদের ইউনিয়নের মাসিক চাঁদা কর্তন বন্ধ করে মৌসুমি শ্রমিকদের ইউনিয়নের সদস্যপদ বিরত রাখার প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করেছে। একইসঙ্গে সিবিএ ইউনিয়নের কতিপয় কর্মকর্তা মালিকের সঙ্গে যোজসাজশ করে ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলে চাঁদা প্রদান না করার জন্য প্রতিষ্ঠানের মৌসুমি শ্রমিকদের বাধ্য করেছে। মৌসুমি শ্রমিকরা ২০১৩ ও ২০১৫ সালে শ্রমিক বা কর্মচারী ইউনিয়নে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাকি তিনটি নির্বাচনে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ভোট দিতে দেয়নি।

এ বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান শেয়ার বিজকে বলেন, অবশ্যই আইন মানা উচিত। শুধু শ্রম আইন নয়, আমাদের দেশে ভালো কিছু আইন হয়েছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। শ্রমিকদের অধিকার বা সুরক্ষাÑযাই বলুন না কেন, সবার মেনে চলা উচিত। আমাদের দেশে গার্মেন্টস খাতে হয়তো বায়ার বা ক্রেতাদের চাপ বা চাহিদার কারণে গার্মেন্টস খাতে শ্রম আইন মানা হয়। কিন্তু সিগারেট কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানি বলে তারা আইন মানবে না, তা তো কাম্য নয়। বরং তাদের আরও বেশি শ্রম আইন মানা উচিত।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বিএটি বাংলাদেশ এর সঙ্গে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। পরে একটি পিআর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লিখিত জবাব পাঠায় বিএটি। যাতে বিএটির মুখপাত্রের বরাতে বলা হয়, ‘দেশের সকল আইনানুগ নিয়মনীতি মেনে দীর্ঘ ১১৪ বছর ধরে এই দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিএটি বাংলাদেশ। ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার মানদণ্ড অটুট রেখে বাংলাদেশের আইন মেনে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে বিএটি বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর।’