নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ কাঠামোকে আরও সংগঠিত ও কার্যকর করতে নতুন শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল (এসএসি) গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি নমিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্ভাব্য সদস্যদের একটি তালিকা কমিশনের কাছে জমা দেবে।
কমিশনের পক্ষ থেকে ৪ জুন এ-সংক্রান্ত একটি আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হয়েছে, যেখানে স্বাক্ষর করেছেন বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশিদ মাকসুদ। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন আগের ৯ সদস্যবিশিষ্ট এসএসি বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগের নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হচ্ছে।
নতুন গঠিত মনোনয়ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান নিজেই। এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেনÑবিএসইসির কমিশনার (আইন), ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত প্রফেসর বা সমমর্যাদার প্রতিনিধি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মনোনীত শাইখুল হাদিস/প্রধান মুফতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন পরিচালক পদমর্যাদার প্রতিনিধি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুষ্টিয়া) থিওলোজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ডিন কর্তৃক মনোনীত প্রফেসর, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব বা তার মনোনীত প্রতিনিধি, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের মনোনীত প্রতিনিধি এবং বিএসইসির শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েটের সদস্য সচিব।
এই প্রতিনিধিত্বশীল কমিটি বাজারে শরিয়াহ সম্মত সিকিউরিটিজ ব্যবস্থাপনার জন্য একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শরিয়াহ-জ্ঞানসম্পন্ন পরামর্শদাতা পরিষদ গঠনের পথে কাজ করবে।
২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর বিএসইসি ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (সিকিউরিটিজ মার্কেট শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল) রুলস, ২০২২’ শীর্ষক একটি গেজেট প্রকাশ করে। এ গেজেটে শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল গঠনের নিয়ম-কানুন, সদস্যদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং দায়িত্ব-কর্তব্য বিস্তারিতভাবে নির্ধারণ করা হয়। রুলস-এর ৩, ৪ ও ৫ ধারায় নির্দিষ্টভাবে বলা হয়, কাউন্সিলের সদস্য হতে হলে প্রার্থীকে শরিয়াহ, ইসলামিক অর্থনীতি কিংবা সংশ্লিষ্ট খাতে নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এর আগে ২০২৩ সালের ২৮ মে তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সময় একটি শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্তমান নেতৃত্ব সেই নির্দেশনাকে বাতিল করে নতুনভাবে কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
নতুন শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের মূল ভূমিকা হবে, ইসলামি শরিয়াহসম্মত সিকিউরিটিজের মানদণ্ড নির্ধারণ, শরিয়াহসম্মত ইস্যুগুলোর ওপর মতামত প্রদান, শরিয়াহ গাইডলাইন তৈরি এবং বিএসইসিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া। অর্থাৎ কেবল সিদ্ধান্ত নয়, ভবিষ্যতের শরিয়াহভিত্তিক পুঁজিবাজার উন্নয়নের নীতিমালাও গঠিত হবে এ কাউন্সিলের হাত ধরে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইসলামি বিনিয়োগ কাঠামো যতটা সম্ভাবনাময়, বাস্তবে তা এখনও সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ ধরনের একটি নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং শরিয়াহপ্রধান পরামর্শক কাউন্সিলের মাধ্যমে ইসলামী বন্ড (সুকুক), শরিয়াহভিত্তিক মিউচুয়াল ফান্ড, ইসলামি ইনডেক্সসহ নানামুখী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের জন্য একটি সুসংগঠিত ও গ্রহণযোগ্য কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব হবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক আবুল কালাম বলেন, ‘নতুনভাবে একটি শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত কমিশন ইতোমধ্যে নিয়েছে। আমরা এমন সদস্য নির্বাচন করতে চাই যারা শরিয়াহ, অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারে সমানভাবে দক্ষ। এ লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি নমিনেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে কাউন্সিল গঠন করা হবে।’
তিনি আরও জানান, পুঁজিবাজারে শরিয়াহভিত্তিক পণ্য আরও জনপ্রিয় করতে হলে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পরামর্শদাতা কাউন্সিল অপরিহার্য। নতুন কমিটি সেই কাঠামো গঠনের পথপ্রদর্শক হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী অর্থনীতির দর্শনের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি কাঠামো তৈরি হলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালেও দীর্ঘদিন ধরে নির্ভরযোগ্য কাউন্সিল ও পরিকাঠামোর অভাব ছিল। নতুন এ উদ্যোগ সেই ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা তৈরি করছে।
এখন দেখার বিষয়, মনোনয়ন কমিটির কাজ কতটা দক্ষভাবে সম্পন্ন হয় এবং বিএসইসি কত দ্রুত নতুন কাউন্সিল গঠন করে তা কার্যকর করে তুলতে পারে।