Print Date & Time : 28 July 2025 Monday 10:06 pm

বিএসসির ‘গাফিলতি’ ছিল: বিএমএমওএ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম:যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটিকে ইউক্রেনে পাঠানোর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ‘গাফিলতি’ ছিল বলে অভিযোগ করেছে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকদের সংগঠন। গতকাল চট্টগ্রামের স্ট্র্যান্ড রোডে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যা তথ্য জেনেছি, তার ভিত্তিতে বলছি, জাহাজটির ইউক্রেনে যাওয়া এড়ানো যেত। এখানে বিএসসির গাফিলতি ছিল বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের আজ এ মৃত্যু ও নাবিকদের দুর্দশা দেখতে হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় মূলব্যান সম্পত্তি বাংলার সমৃদ্ধির চরম ক্ষতি হয়েছে। এই মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির দায় কে নেবে?’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পাঁচটি প্রশ্ন তুলে ধরেন বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘যেখানে ১৫ ফেব্রুয়ারি জয়েন্ট ওয়ার কমিটি ওই জায়গাকে যুদ্ধকবলিত অঞ্চল ঘোষণা করল, সেখানে কেন জাহাজটি জেনে-বুঝে ২২ ফেব্রুয়ারি ওই অঞ্চলে প্রবেশ করল? এটা সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ। চার্টার পার্টি বিধিমালা অনুযায়ী কোনো জাহাজ কোম্পানি তার জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধকবলিত এবং জলদস্যুপ্রবণ এলাকায় জাহাজ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। অথচ এক্ষেত্রে মালিক কর্তৃপক্ষ বিএসসির পক্ষ থেকে জাহাজটিকে যুদ্ধকবলিত এলাকায় যওয়ার অনুমতি দেয়া হলো!’

বাংলার সমৃদ্ধির মালিকানা বিএসসির হলেও ডেনিশ কোম্পানি ডেলটা করপোরেশনের অধীনে সেটি ভাড়ায় চলছিল। মুম্বাই থেকে তুরস্ক হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে যায় জাহাজটি। ওই বন্দর থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল বাংলার সমৃদ্ধির। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে ২৯ জন ক্রু নিয়ে জাহাজটি আটকে পড়ে।

এর মধ্যে গত বুধবার সন্ধ্যায় রকেট হামলায় জাহাজের ব্রিজ ধ্বংস হয়ে যায়, মৃত্যু হয় এক প্রকৌশলীর। ক্ষোভ আর উদ্বেগের মধ্যে বৃহস্পতিবার জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ২৮ নাবিক ও প্রকৌশলীকে সরিয়ে নেয়া হয় নিরাপদ স্থানে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিএসসির দাবি, যাদের কাছে জাহাজটি ভাড়া দেয়া ছিল, তাদের ইচ্ছার বিপরীতে যাওয়ার সুযোগ এক্ষেত্রে ছিল না।

এ বিষয়ে সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘বিএসসি বলছে চুক্তির শর্তের কারণে তারা জাহাজটি নিয়ে গেছে। আরেকটি তথ্য আমরা জানতে পেরেছি, একই চার্টারে বিএসসির আরেকটি জাহাজ ছিল, যেটি তারা যুদ্ধ লাগার পর ইউক্রেনে নিয়ে যেতে চায় এবং বিএসসি ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের না বলে দেয়। তার মানে ইউক্রেনে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর অধিকার বিএসসির আছে। কিন্তু সে অধিকার তারা (বাংলার সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে) প্রয়োগ করেনি। আর সে কারণেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যে শর্তের কথা তারা বলেছে, তা সঠিক নয়।’

বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিআইএমসিও) ওয়ার রিস্ক ক্লজ ফর টাইম চার্টারিং (কনওয়ারটাইম ২০১৩)’-এর বি ধারায় বলা আছে, ‘যুদ্ধের ঝুঁকি আছে এমন কোনো স্থানে মালিক বা মাস্টার যুক্তিসংগত কারণে যেতে বাধ্য নন।’ তাহলে কোন পরিস্থিতিতে কোন শর্তের কারণে বিএসসি জাহাজ পাঠালÑসেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।

সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘আমরা চাই একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি হোক। তাহলে কীভাবে বিএসসি জাহাজ অপারেট করেছে, কী কারণে সেখানে পাঠিয়েছে, তা জানা যাবে। ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, বাংলার সমৃদ্ধি যুদ্ধকবলিত এলাকায় আটকে যাওয়ার পর নাবিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপও শুরুতে তারা দেখেননি।

বুধবার স্থানীয় সময় বিকাল সোয়া পাঁচটায় জাহাজে রকেট হামলা হলে ব্রিজে থাকা থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান মারা যান। জাহাজের বাকি ২৮ নাবিক সেদিন থেকে বারবার তাদের সরিয়ে নেয়ার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার বিকালে তাদের নামিয়ে নেয়া হয়।

রাতে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, জাহাজের ২৮ ক্রুকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, হাদিসুরের মরদেহও তাদের সঙ্গে রয়েছে। হাদিসুর রহমানের মরদেহ কীভাবে দেশে আনা হবে, জানতে চেয়ে বিএমএমওএ নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলনে চারটি দাবি তুলে ধরেন।

দাবিগুলো হলো: হাদিসুর রহমানকে ‘রাষ্ট্রীয় বীর’ ঘোষণা করে তার মরদেহ দেশে এনে দাফনের ব্যবস্থা করা। ২৮ নাবিককে অতি দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা। জাহাজ পরিচালনায় বিএসসির গাফিলতি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা এবং সেই কমিটিতে বিএমএমওএ’র দুই প্রতিনিধি রাখা। রকেট হামলার শিকার জাহাজটিকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করায় নাবিকদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও পুরস্কার দেয়া। বিএমএমওএ কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. ওমর ফারুক তুহিনের মা মোছাম্মৎ খায়রুন নেছা, মামা ক্যাপ্টেন এএফএম জহির উদ্দিন এবং ছোট ভাই ওমর শরীফ তুষারও উপস্থিত ছিলেন।