বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। নানা অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে প্রকল্পটি। এতে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ-সংক্রান্ত নানা তথ্য। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব
বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত)’ নামে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা প্রকল্পের কার্যক্রম। বৃহত্তর কুমিল্লার (কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর) ৩৪টি উপজেলায় মৎস্য চাষ ও মৎস্য খাতে উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকারি অর্থায়নে প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার শুরু থেকেই প্রকল্প-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পে জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক উপকরণ (এআইজিএ) সেলাই মেশিন ও বেড় জাল ক্রয়ে লাখ লাখ টাকা অনিয়মিত ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে আরডিপিপি’র নির্দেশনা উপেক্ষা করে উš§ুক্ত টেন্ডার আহ্বান ব্যতীত আরএফকিউ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত দরে জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক উপকরণ (এআইজিএ) সেলাই মেশিন ক্রয়ে সীমাহীন অনিয়ম হয়। এতে সরকারের প্রায় ৪০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়।
অপরদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য ওটিএম পদ্ধতিতে বেড় জাল ক্রয় করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও আরএফকিউ পদ্ধতিতে উন্নয়ন বাজেটের অধীন বার্ষিক ক্রয়সীমার ঊর্ধ্বে জেলার বিভিন্ন উপজেলা মৎস্য অফিস কর্তৃক ১০টি বিলের মাধ্যমে আরএফকিউ পদ্ধতিতে ১০০টি বেড় জাল ক্রয় করা হয়। এতে অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পের ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে ডিপিপি, বরাদ্দ ও ব্যয় বিররণী, জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক ক্রয়-সংক্রান্ত নথি ও বিল ভাউচার এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নিরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দাখিলকৃত প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, আরডিপিপি’র সংযোজনী অনুযায়ী কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলার জন্য ওটিএওম পদ্ধতিতে জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক উপকরণ (এআইজিএ) সেলাই মেশিন সেট এবং বেড় জাল ক্রয় করার নির্দেশনা থাকলেও প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম ধাপে নির্দেশনা অনুযায়ী ওটিএম পদ্ধতিতে ৪২০ সেট সেলাই মেশিন ও সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়।
মেসার্স শিল্পী স্টোর নামে একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৫ নম্বর বিলের মাধ্যমে ১১ হাজার ৮৯৮ টাকা দরে সেই সেলাই মেশিন সেট ও সরঞ্জাম প্রকল্পে সরবরাহ করে। একই বিলের সাব-সরবরাহকারী চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বাবুল স্টোর ১১, ১২ ও ২৪ নম্বর বিলে ২০১৯ সালে ৯০ সেট সেলাই মেশিন প্রকল্পে সরবরাহ করে।
বাবুল স্টোরের স্বত্বাধিকারী হাজীগঞ্জ বাজার থেকে সবচেয়ে নিুমানের প্রতি সেট মেশিন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকায় ক্রয় করে প্রকল্পে ১১ হাজার ৮৯৮ টাকার বিল প্রদান করে। এ ৯০ সেট মেশিন সরবরাহ করে বাবুল হাতিয়ে নেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৭২০ টাকা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বাবুল স্টোরের স্বত্বাধিকারী প্রকল্পে সেলাই মেশিন সেট ও সরঞ্জাম সরবরাহ না করার অভিযোগ রয়েছে।
একইভাবে ফরিদগঞ্জেও এক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যক্তির সহায়তায় প্রকল্পে ১৪০ সেট মেশিন একই দামে সরবরাহ করা হয়। সেখানেও নিুমানের সেলাই মেশিন ও সরঞ্জাম সরবরাহে মধ্যস্বত্বভোগী হাতিয়ে নেন প্রায় দুই লাখ টাকা। প্রকৃত মেশিন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধানকালে এমন তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তী ধাপে আবারও আরডিপিপি’র নির্দেশনা উপেক্ষা করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত দরে ৯৫০ সেট ১৬ হাজার টাকা, ২০ সেট ১৫ হাজার ৯৯০ টাকা এবং ২০ সেট ১৫ হাজার ৯০০ টাকা দরে ক্রয় করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। উল্লিখিত দরে ৯৯০ সেট সেলাই মেশিন ও সরঞ্জামের ক্রয়মূল্য এক কোটি ৫৮ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ টাকা। ৯৫০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৩৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ টাকা, ২০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৮১ হাজার ৮৪০ টাকা এবং আরও ২০ সেট সেলাই মেশিন ক্রয়ে ৮০ হাজার ৪০ টাকা দরে ক্রয় করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৮০ টাকা।
আরএফকিউ পদ্ধতিতে বার্ষিক ক্রয়সীমার ঊর্ধ্বে উন্নয়ন বাজেটের অধীনে জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধনমূলক উপকরণ ক্রয় বাবদ এক কোটি ৫৮ লাখ সাত হাজার ৮০০ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অনুযায়ী উন্নয়ন বাজেটের অধীন পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের জন্য বার্ষিক সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা আর্থিক মূল্যসীমা নির্দিষ্ট রয়েছে। এসবের তোয়াক্কা না করে প্রকল্প অফিস কর্তৃক আরএফকিউ পদ্ধতিতে উন্নয়ন বাজেটের অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এআইজিএ উপকরণ সেলাই মেশিন ও বেড় জাল খাতে বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। এতে আরডিপিপি সংযোজনী, পিপিআরের বিধি ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশের লঙ্ঘন করা হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এখন পর্যন্ত সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে কোনো জবাব দেয়নি প্রকল্প অফিস।
প্রকল্পের আওতায় মৎস্য চাষ ও মৎস্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, স্থানীয় মৎস্যসম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ সরকারি খাস পুকুর, বিল, জলাভূমি খনন, পুনঃখনন ও মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হলেও এসব কাজেও প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সীমাহীন অনিয়ম আর উদাসীনতায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ভাটা পড়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আবদুছ সাত্তার শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।