আরিফুল ইসলাম, সাভার (ঢাকা): ২০১৩ সালে ঢাকার সাভারে ধসে পড়েছিল রানা প্লাজা নামে একটি ভবন। সেই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক হাজার ১৩৬ শ্রমিক। আহত হন কয়েক হাজার। এর ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বিচার, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের সুযোগ পাননি হতভাগ্যরা। এত বছর পরেও তাই তাদের চাওয়াÑঅবিলম্বে ন্যায্য বুঝে পাওয়া। আর এসব ক্ষোভ নিয়েই প্রতি বছরের মতো এ বছরও রানা প্লাজা দিবস পালন করছেন স্বজনহারানো মানুষেরা এবং নিজের শরীরে ক্ষত বয়ে বেড়ানো শ্রমিকরা।
তাদের দাবি, সেই ২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া দাবিদাওয়ার আহ্বান এখনও একই। তবে মেলেনি কিছুই। রানা প্লাজায় নিজের দুই ছেলেকে হারানো রুবি আক্তার জানান, তার বড় ছেলে কাজ করত আটতলায়, আর ছোট ছেলে ছয়তলায়। বড় ছেলের লাশ পেলেও ছোট ছেলে এখনও নিখোঁজ। দুর্বিষহ কষ্টে জীবনযাপন করছেন তিনি।
রুবি আক্তার বলেন, ‘আমার বড় ছেলে আবু জাফর সেন্টু ছিল আটতলায়। ছোট ছেলে সেকেন্দার ছিল ছয়তলায়। বড় ছেলের লাশ পেয়েছি ১৬ দিন পর। তাকে ভেকু দিয়ে কেটে উদ্ধার করা হয়। সেই লাশ পাই। আর ছোট ছেলেটাকে পাইনি। সে এখনও নিখোঁজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বড় ছেলে এক ছেলেসন্তান রেখে যায়। তাকে মাদ্রাসায় পড়াই। তাকে নিয়েই আছি। চায়ের দোকান করি। এভাবেই আছি। এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। বিচারটাও পেলাম না।’
রানা প্লাজায় আহত আরেক শ্রমিক মনির হোসেন বলেন, ‘পৌনে ৯টায় বিদ্যুৎ গেছে। তখন জেনারেটর চালু করল আর ভবন ধসে পড়ল। তখন আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি চারতলায় চাকরি করতাম। পায়ের কাছে যে মেশিন ছিল, সেটা পায়ে গেঁথে গেল। আমি পড়ে গেলাম। এর ১০-১৫ মিনিট পর জ্ঞান ফিরলে দেখি ভবনে আটকে পড়েছি। তখন চিৎকার-চেচামেচি শুনতে থাকি। বের হওয়ার রাস্তা নেই। এভাবে তিন দিন আটকে ছিলাম। বুধবার ওই ঘটনার পর শুক্রবার ২টায় উদ্ধারকর্মীরা বের করেন।’
বর্তমানে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনও অসুস্থ। পাঁচ মাস আগেও অসুস্থ হয়ে পড়ি। লিভারে সমস্যা। রক্ত বমি হয়। হাসপাতালে ভর্তি হলে লাখ টাকা খরচ হয়, কিন্তু টাকা পাইনি।’
ভবনের ছয়তলায় কাজ করা শ্রমিক সালেহা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘১২ বছর কী করল সরকার। বছর পেরোলে নেতারা আসেন, ছবি তোলেন; কিন্তু কিছুই পেলাম না। বিচারও হলো না।’
১১ বছর পরেও সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারেন না তাসলিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘সব সময়ই সেই দিনের কথা মনে পড়ে। আজীবন মনে হয় ভুলতে পারব না। কেউ কিছু করল না আমাদের জন্য। এখন বোতল কুড়িয়ে খাই, পা ভাঙা। কোনো কাজ করতে পারি না। আমাদের এমন যারা করল তাদের বিচার হলো না। এখন দোয়া করি, যাতে আল্লাহ বিচার করে।’
এদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এখনও শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা বুঝে পাননি। এজন্য উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তারা। টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘মামলার বিচারে সরকারের সদিচ্ছার দরকার। মামলা করেছে সরকার। তারা চাইলে এত দিনে বিচার হতো। ১১ বছরে এ মামলায় ৪৮ বার দিন পড়েছে। গতকাল সরকারের প্রসিকিউটর এক সভায় বলেছেন নানা রকম সমস্যা আছে। পাঁচশ’র মতো সাক্ষী পাওয়া যায় না। তারা বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন, আসা-যাওয়ার খরচ পান না। সেখান থেকে আইনজীবীরাও টাকা পান না। আগামী বছর এটির এক যুগ পূর্তি হবে। তার আগে আমরা এ মামলার বিচার চাই।’
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘রানা প্লাজার ১১ বছর পার হচ্ছে। কিন্তু এখনও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসা কোনোটাই দেয়া হয়নি। আরও দুঃখজনক হলো, ১১ বছরেও এ ঘটনার সঙ্গে দায়ীরা দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। আমরা চাই, অবিলম্বে রানা প্লাজা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এ ঘটনার সঙ্গে যারা দায়ী তাদের বিচার করতে হবে।’
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, এ বিষয়ে আমাদের যতটা সুযোগ আছে আমরা কাজ করছি। আমাদের সীমার মধ্যে যতটা সম্ভব কারখানা পরিদর্শন করে তাদের আমাদের পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছি, যাতে তারা ঠিক করে। পরে আবারও যাচাই করছি, তারা করছে কি না।’