Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 5:46 pm

বিদেশগামীদের ঋণ দিচ্ছে মাত্র একটি ব্যাংক

শেখ শাফায়াত হোসেন: ব্যাংকের প্রস্তাবিত সুদের পাশাপাশি নানা ধরনের সেবা মাশুলের কারণে ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অভিবাসী কর্মীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক জরিপে অংশ নেওয়া অভিবাসী কর্মীদের স্বজনরা এ অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, ঋণের সুদের পাশাপাশি ডকুমেন্টেশন ফি, স্ট্যাম্প ফি, সিআইবি রিপোর্ট ফি, লোন প্রসেসিং ফি, বিমা ফি, মূসক প্রভৃতি বাড়তি সেবা মাশুল দিতে হয়েছে অভিবাসী কর্মীদের।
‘বিদেশগামীদের ঋণের ব্যবহার ও তার প্রভাব নিয়ে জরিপ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাত্র দুটি ব্যাংক বিদেশ যাওয়ার ঋণ দিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (পিকেবি) ও অগ্রণী ব্যাংক। তবে বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক এই ঋণ কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে বলে জানা গেছে।
জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসী কর্মীদের ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশের বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড় হয়েছে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। এছাড়া প্রায় ১১ শতাংশ অভিবাসীর বিদেশ যাওয়ার খরচ এসেছে জমি বিক্রির টাকা থেকে। পাঁচ শতাংশের বেশি অভিবাসী কর্মী বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বা মহাজনি সুদে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন।
এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ মঞ্জুরির দীর্ঘসূত্রতা, পিকেবির জনবল সংকট, সরকারি কর্মকর্তাদের ঋণের জামিনদার করার বাধ্যবাধকতা এবং বিদেশগমনের উচ্চ ব্যয়ের তুলনায় বিদেশে গিয়ে কম আয় করাকে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেছে ঋণপ্রদানকারী ওই দুটি ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ নিয়ে বিদেশ যাওয়া কর্মীদের ২৭ শতাংশ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পাওয়া, নিম্নমানের কাজ, এনজিও বা মহাজনি সুদ পরিশোধের চাপ, অসুস্থতা, দেরিতে কাজ পাওয়া এবং বেতন কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।
জরিপে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই ধরনের প্রশ্নপত্রের ব্যবহার করেছে। একটি প্রশ্নপত্র ছিল ব্যাংকের জন্য, অন্যটি ছিল সুবিধাভোগীদের জন্য। দেশের ৪০টি জেলায় থাকা ওই দুটি ব্যাংকের ৮০টি শাখার বিদেশগামীদের ঋণের প্রায় ৪০০ জন সুবিধাভোগীর ওপর ওই জরিপ করা হয়। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তথ্য ব্যবহার করেছে।
জরিপে দেখা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের ‘বিদেশ যাওয়ার ঋণ’ স্কিমের আওতায় ২০১৪ সালে মাত্র ৭৮ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ওই স্কিমের আওতায় ঋণ বিতরণ করা হয় দুই কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ২০১৪ সালে ৮৯৯ ঋণগ্রহীতাকে ২৬ কোটি ছয় লাখ টাকা ঋণ দেয়। ২০১৭ সালে এই ব্যাংকটি সাত হাজার ৭৬৩ বিদেশগামীকে ৭৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঋণ দেয়।
২০১৫ সালে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ আদায় ভালোই ছিল। ওই বছর এ খাতের ঋণের আদায় ছিল ৫৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরের দুই বছর অবশ্য এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায়। ২০১৬ সালে এ খাতের ঋণের আদায় কমে শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ হয় এবং ২০১৭ সালে হয় শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আলোচিত তিন বছরেই এ খাতের ঋণের আদায়ে উল্লেখযোগ্য কর্মদক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৪ সালে এই ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের মধ্যে আদায়ের হার ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। ২০১৭ সালে ঋণের আদায় বেড়ে হয় ৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে যেসব অভিবাসী কর্মীর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তার ৭৩ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করছে। বিদেশগামীদের মধ্যে ৬২ শতাংশই অদক্ষ। দুই শতাংশ ছিল দক্ষ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ অভিবাসী কর্মী নিম্নমানের কাজে নিয়োজিত এবং তাদের একটি বড় অংশ (৩৮ শতাংশ) নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত।
জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসী কর্মীদের ৬৫ শতাংশের বিদেশ যেতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকার বেশি। ২৩ শতাংশ বলেছে, তাদের পাঁচ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ বলেছে, তাদের খরচ হয়েছে এক থেকে দুই লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশগামীদের ঋণ দেওয়ায় তা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে। ঋণ নিয়ে বিদেশগামীদের মধ্যে ৮৬ শতাংশই নতুন করে ব্যাংক হিসাব খুলেছে। বিদেশগামীদের মধ্যে মাত্র চার শতাংশ নারী থাকলেও অভিবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীদের মধ্যে ৪১ শতাংশ ছিল নারী। ১১ শতাংশ অভিবাসী কর্মী তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বিদেশে নিতে সক্ষম হয়েছে।
গবেষণা পরিচালনাকারী গভর্নর সচিবালয়ের মহাব্যবস্থাপক ড. হাবিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির প্রধান তিনটি স্তম্ভের একটি রেমিট্যান্স। আমরা জরিপ করতে গিয়ে দেখেছি, এই রেমিট্যন্স প্রেরণকারীদের অনেকেই ঋণ নিয়ে বিদেশ গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় পরে সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। তাছাড়া ঋণের সুদের পাশাপাশি অন্যান্য সেবা মাশুলের কারণেও তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।’
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না-পারাদের ৬৯ শতাংশ যথাযথ কাজ না পাওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। ১৬ শতাংশ এনজিও বা মহাজনি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। এছাড়া সাত শতাংশ অসুস্থতা, ছয় শতাংশ দেরিতে কাজ পাওয়া এবং দুই শতাংশ কর্মীর বেতন কমে যাওয়ায় সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কাজের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশ যাওয়া শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। ওই বছর মাত্র ছয় হাজার ৮৭ কর্মীর বিদেশ যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি বাংলাদেশি কর্মী অবস্থান করছে। ১৯৯১ সালে প্রথম বাংলাদেশ থেকে নারীকর্মী বিদেশ যাওয়া শুরু করে।
বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মোট এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এর ৭৫ শতাংশেরও বেশি এসেছে শীর্ষ সাত দেশ থেকে। এই দেশগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ওমান।