বিদেশি ঋণ পরিশোধে রপ্তানি বাড়ানোর বিকল্প নেই

আবুল কাসেম হায়দার: বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মডেলে প্রবেশ করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের উন্নয়নের অনেক সূচক অগ্রগামী। বর্তমানে সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেলের সূচনা হয়েছে। মানুষ উপকৃত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে এসব মেগা প্রকল্পের উন্নয়নসূচক দেখা যাচ্ছে।

আমাদের এসব মেগা প্রকল্পের ঋণ নেয়া হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশগুলো থেকে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ থেকে সবসময় সব দেশ ঋণ সহযোগিতা নিতে হয়। আমাদের অনেক প্রকল্পে ঋণ সহযোগিতা নেয়া হয়েছে রাশিয়া, চীন, জাপান ও ভারত থেকে। এসব দেশের ঋণের সময়সীমা ১৫ বছর। ঋণের সুদের হারও বেশি।

বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে। গত কয়েক বছরে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণ এ দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ছয় বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ এমনিতেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সামনে ঋণ পরিশোধের এ চাপ আরও বাড়বে। কারণ, আগামী তিন বছরেই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মূলত বিভিন্ন প্রকল্পে চীন ও রাশিয়া থেকে নেয়া বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধের রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে।

এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাড়ে চারশ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এ ঋণ পরিশোধের চাপও সামনে আসবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভারত, চীন ও রাশিয়ার ঋণগুলো বাণিজ্যিক এবং পরিশোধের সময়ও বেশ কম। এখন কিছু কিছু ঋণের কিস্তি শুরু হয়ে গেছে। তাই ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। যেহেতু এখন অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, তাই আগামী পাঁচ-সাত বছর এ ধরনের বাণিজ্যিক ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

কঠিন শর্তের এসব ঋণের কয়েকটি প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ উঠে আসবে না বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, চীনের অর্থায়নে পদ্মা রেলসংযোগ সেতু থেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে আনা কঠিন হবে। কারণ, রেলওয়ে এখনও সনাতনী ব্যবস্থায় চলছে। দুর্বল পরিকল্পনা ও দুর্নীতি রেলওয়েকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া রাশিয়ার ঋণের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও সরকারের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।

ঋণ পরিশোধ ৪০০ কোটি ডলার ছাড়াবে: অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ১১২ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। ছয় মাসে এত ঋণ পরিশোধ আগে কখনোই হয়নি। সামনে আরও বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এমন পূর্বাভাসও মিলেছে ইআরডির এক প্রতিবেদনে। নতুন ঋণ চুক্তি নাহলে এবং শুধু পাইপলাইনে থাকা প্রতিশ্রুতি থেকে ঋণ মিললে এবং ডলারে আগামী কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে, তা দেখানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। প্রতি বছরই এ পরিমাণ বাড়বে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৪০২ কোটি ডলার। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। এরপর ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১১৭ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল সরকারকে। এরপর প্রতি বছরই তা বেড়েছে। ২০২১-২২                অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২০১ কোটি ডলার। তার মধ্য দিয়ে গত অর্থবছরে প্রথমবারই মতো বার্ষিক ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলার ছাড়াল। প্রতি বছর যত বৈদেশিক সহায়তা এ দেশে আসে, তার এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হয়।

ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ছে: গত এক দশকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ এত দিন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আসছে।

এখন আস্তে আস্তে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে তুলনামূলক কঠিন শর্তে শত শত কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। এসব ঋণের অসুবিধা হলো বিশ্বব্যাংক, এডিবি কিংবা জাপানের ঋণের তুলনায় এসব ঋণ পরিশোধের সময় বেশ কম।

গত এক দশকে এই তিন দেশের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চুক্তি হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে চীনের ১২ প্রকল্পে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, রাশিয়া রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার এবং ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) ৭৩৬ কোটি ডলার দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক, এডিবির ঋণ পরিশোধের জন্য মোটাদাগে সময় পাওয়া যায় ৩২ থেকে ৩৫ বছর। কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের পর চীন ও ভারতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১৫ থেকে ২০ বছরে।

দুটি প্রকল্পের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নেয়া ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে হবে মাত্র ১০ বছরে। ২০২৬ সালে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণে ১৯৫ কোটি ডলার দিয়েছে চীন। এ প্রকল্পের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি অর্থবছর থেকে এ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ তিন দেশের ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হয়েছে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক লেনদেনের সুদের হারের (লাইবর) সঙ্গে পৌনে ২ শতাংশ সেবা মাশুল যুক্ত করে। লাইবর সাধারণত আড়াই থেকে ৩ শতাংশ হয়। সুদের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো সংস্থার চেয়ে খুব বেশি তফাত নেই।

এখন কী ধরনের পদক্ষেপ জরুরি: এক. ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারকে নতুন করে ঋণ নেয়া ও ঋণ পরিশোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের খাতগুলো পর্যালোচনা করে ঋণ পরিশোধের চাহিদা তৈরি করতে হবে।

দুই. নতুন করে আপাতত: মেগা প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত। আয় অনুযায়ী ব্যয়সংকোচনের নীতিতে প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।

তিন. দেশে শিল্প খাতের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিল্প খাতের পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি স্থগিত করা প্রয়োজন। রপ্তানি কমে গেলে মেগা প্রকল্পের ঋণ শোধের গতি কমে যাবে। সরকার সমস্যার সম্মুখীন হবে। মাত্র কয়েক দিন আগে গ্যাসের মূল্য ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে স্পিনিং খাতসহ বস্ত্র খাতের উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। বিষয়টি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

চার. আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান খাত হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প খাত। দ্বিতীয় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। এখন প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি। অদক্ষ জনশক্তির উপার্জন খুবই কম। প্রতিটি উপজেলায় দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির জন্য সরকার কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিচালনা নিয়েছে। কিছু উপজেলায় দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির জন্য ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাও মানসম্পন্ন হয় নেই। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিটি উপজেলায় তৈরি করা প্রয়োজন, যা থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে। বিদেশে গিয়ে অধিক বেতনে চাকরির সুযোগ পাবে। উপার্জন বেশি হবে। যার ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

পাঁচ. দেশের অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করার জন্য সরকার বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফ, এডিবি পৃথিবী খ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে স^ল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। এটি এখন খুবই প্রয়োজন। ইতোমধ্যে আইএমএফ ৪৫০ বিলিয়ন ঋণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। দ্রুত অর্থ ছাড় এখন প্রয়োজন।

ছয়. দেশে অপচয়, দুর্নীতি, অর্থ পাচার বন্ধ করার জন্য সরকারের উদ্যোগকে আরও বেশি সক্রিয় ও দৃশ্যমান করা প্রয়োজন। দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে হবে। আমাদের এখন বড় সমস্যা দুর্নীতি ও ঘুষবাণিজ্য। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইন্সুরেন্স শেয়ারবাজার প্রভৃতি অনিয়ম দুর্নীতি ও আইনের শাসনের অভাবে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। অর্থ ব্যবস্থায় আইনের শাসন দ্রুত কায়েম করতে হবে। আর্থিক খাতকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। আর্থিক খাতকে তার নিজস্ব গতিতে, আইনের পরিচালনার সুযোগ দেয়া উচিত। তাতে আর্থিক খাত সঠিক পথে চলবে। দেশের শিল্পবাণিজ্য বিকাশে অবদান রাখতে পারবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় আর্থিক খাতের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। তাই ব্যাংকিং আইনের সংস্কার প্রয়োজন। দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি আনা প্রয়োজন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানে সরকার ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশি ঋণ শোধ অধিক রপ্তানি ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনই আমাদের মূল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি. অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

aqhaider@youthgroupbd.com