অর্থবছরের প্রথম ৫ মাস

বিদেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি হ্রাস ৯১% পরিশোধ বেড়েছে ২৮ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমানে বৈদেশিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাঁক পরিবর্তনের মুখোমুখি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতিতে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে ঋণ ছাড়ের হারও। তবে একই সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের আর্থিক পরিস্থিতিতে আরও চাপ তৈরি করেছে। গতকাল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এ তথ্য জানানো হয়। তথ্য অনুসারে, পাঁচ মাসে দেশে ১৫৪ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বিদেশি ঋণ এসেছে। তবে এ সময় বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছে ১৭১ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর এ সময়ে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ২৭ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯১ দশমিক ০৮ শতাংশ ও ঋণ ছাড় কমেছে ২৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের আর্থিক সম্পদগুলোর ওপর চাপ বাড়ানোর প্রতিফলন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের অনেকে বাংলাদেশকে কয়েকশ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এসব ঋণ প্রাপ্তি নির্ভর করছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচির ওপর। সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে মূলত অতিরিক্ত ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে সংস্কার কর্মসূচি শুরু না হওয়ায় এসব ঋণ প্রাপ্তি বিলম্বিত হচ্ছে।ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে উন্নয়ন অংশীদারদের ঋণ প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল ৫৮৫ কোটি ৯২ লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর একই সময়ের ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে ৫৩৩ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছর ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ২১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছর তা কমেছে ৫৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।

এদিকে গত অর্থবছর প্রথম পাঁচ মাসে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৩৩ কোটি ২২ লাখ ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৭ কোটি ডলার ও সুদ ৫৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। যদিও চলতি অর্থবছর আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার ও সুদ ৬৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার। অর্থাৎ আসল পরিশোধ বেড়েছে ৩৭ দশমিক ১৩ শতাংশ ও সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আগামীতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হতে পারে। ঋণ প্রতিশ্রুতি এবং বিতরণের হ্রাস বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ঋণ পরিশোধের খরচ বৃদ্ধি সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ খাতে (যেমন অবকাঠামো এবং সামাজিক কর্মসূচি) বিনিয়োগ সীমিত করতে হতে পারে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, জুলাই এবং আগস্ট মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে; যার ফলে বিতরণ কমেছে। অনেক বৈদেশিক ঋণ দ্বারা তহবিলপ্রাপ্ত প্রকল্প স্থগিত হয়ে গেছে। কারণ বিদেশি পরামর্শক এবং কর্মীরা অনুপস্থিত ছিলেন। সরকার বর্তমানে ঋণ প্রস্তাবগুলোর পর্যালোচনা করছে, যা নতুন ঋণ চুক্তির জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে। পর্যালোচনা শেষ হলে সরকার ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা করছে এবং তার লক্ষ্য পূরণের জন্য চেষ্টা করবে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার বৈদেশিক অর্থায়নে প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ইআরডির পক্ষ থেকে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে বৈদেশিক ঋণ বরাদ্দের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি তালিকা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিবি ছিল সর্বোচ্চ বিতরণকারী অংশীদার; তারা দিয়েছে ৩১৮ মিলিয়ন ডলার। এরপর জাপান ৩০৮ মিলিয়ন ডলার, রাশিয়া ২৪৫ মিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক ২০৫ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ৬৩ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, যদি দেশের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি না পায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নত না হয়, তবে ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ একটি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ এবং বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া আগামীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ শোধের চাপও যুক্ত হবে।
যদিও কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। প্রায় ১০ বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা পৌনে ৩০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ৩৩৬ কোটি ডলার দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। অর্থাৎ গত এক যুগে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় আট দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি।