চট্টগ্রাম বন্দর

বিদেশি বিনিয়োগ আনতে সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম : গত এক দশকে দেশে ধারাবাহিকভাবে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ। এ ধারা থেকে বের হতে হলে বিদেশিদের জন্য লাভজনক খাত উš§ুক্ত করতে হবে। সেই হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা ব্যবসা বিদেশিদের যুক্ত করা অন্যতম ভালো বিকল্প। কারণ বন্দরের একাধিক টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি অপারেটররা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণে বিনিয়োগে আগ্রহী। অপরদিকে ব্যাংক ঋণের উচ্চ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, অবকাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে অন্য কোনো খাতের বিনিয়োগের সম্ভাবনা তেমন নেই। সেই চিন্তার আলোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিদেশিদের জন্য বন্দর ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে দেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ২১ কোটি ৩০ লাখ ইউএস ডলারের। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নিট এফডিআই ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমে গেছে।

গত কয়েক মাস ধরেই এফডিআই কমে যাওয়ার প্রবণতা চলছেই। যদিও গত কয়েক বছর এফডিআইতে ছিল নিম্নমুখী প্রবণতা। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি ডলার। সেটি কমতে কমতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে আসে ১৪১ কোটি ডলারে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নীতি অনিশ্চয়তার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা আরও কমে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে; যা অর্থবছর শেষে আরও স্পষ্ট হবে। কারণ চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ছিল ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিগত সরকারের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিদেশিদের জন্য বন্দর ব্যবস্থাপনা উš§ুক্ত করতে যাচ্ছে। কারণ ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংকটে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর টুল পোর্ট থেকে ল্যান্ড লর্ড প্রথা অর্থাৎ জমিদারি মডেলে প্রবেশ করেছে। এর অংশ হিসাবে এক বছর আগে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ের নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার কাজ দেয়া হয়। তারা টার্মিনালে যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে টার্মিনাল পরিচালনা করে কনটেইনার প্রতি নির্দিষ্ট ফি বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করবে। যদিও যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে এ টার্মিনাল এখনও পুরোপুরিভাবে অপারেশন পরিচালনা করতে পারছে না।

একইভাবে লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) আন্তর্জাতিক মান, দক্ষতা ও গতি আনার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের আশায় সরকার বন্দরের এ টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে এনসিটি পরিচালনার জন্য দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সবুজ সংকেত দেয় সরকাল। দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে জানান সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

এছাড়া লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের জন্য ডেনিশ শিপিং জায়ান্ট এপিএম গ্রুপের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের তালিকায় রয়েছে বে টার্মিনাল প্রকল্পের টার্মিনাল ওয়ান ও টার্মিনাল টু। এসব টামিনালে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে বলে ধারণা পাওয়া যায়।

বেসরকারি খাতের দেশীয় একাধিক বিনিয়োগকারীরা বলেন, ‘দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার এখন ১৫ শতাংশের বেশি। এত সুদ দিয়ে এখানে বিনিয়োগ করবে কে? উচ্চ সুদ ছাড়াও আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয়ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। বিদেশিরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেন না।

সুতরাং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের কাছে বন্দর ব্যবস্থাপনা ছাড়া বিকল্প নেই। আর স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে ঋণ নেন। বিদেশিরা তখনই বিনিয়োগ করেন যখন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এখন নানা কারণে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না।’

চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের কাছে ইজারা দেয়া নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রফেসর আনু মুহাম্মদ তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় যে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের টার্মিনাল পরিচালনা করতে দেয়নি, সেই ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতেই অন্তর্র্বর্তী সরকার কোনো বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার ভার তুলে দিতে চাচ্ছে?!’

চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, আধুনিক বিশ্বে বন্দর পরিচালনায় সরকারি ও বেসরকারি মডেল একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। এর মধ্যে সৌদি রেড সি গেটওয়েকে সংযুক্ত হয়েছে। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের জন্য ডেনিশ শিপিং জায়ান্ট এপিএম গ্রুপের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু এটি নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে পিপিপির মধ্যে নতুন টার্মিনাল অপারেটরের নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এসব প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ হতে পারে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

গত বুধবার চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চট্টগ্রম বন্দর বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন কোনো অধ্যায়ে প্রবেশ সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি পাল্টাতে হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরই হলো ভরসা। আর বিল্ড অপারেটর অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে টার্মিনাল অপারেশন চুক্তিতে যাবে। অর্থাৎ তোমরা বানাও তোমরাই কাজ কর। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে আমাদের দিয়ে দিতে হবে। আমরা এক পয়সাও খরচ করব না। তাহলে পয়সাও বাঁচল আবার কাজটাও হয়ে গেল। এছাড়া যাদের সঙ্গে কাজ করতে চলেছি তারা সারা দুনিয়ার শত শত পোর্ট পরিচালনা করছে। বন্দর অপারেশনে তারা দুনিয়ার সেরা। এ বিশ্বসেরা অপারেটরদের যদি পাঁচ বছর লাগে অপারেশনে যেতে, এরই মধ্যে আমাদের জনবল অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে তাদের সঙ্গে কাজ করে। একটা পর্যায়ে এদের ওপরই আস্থা রাখতে হবে অপারেটরদের। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, তারও পাঁচ বছর পর বিশ্বের যত দেশে যত বন্দর চালায়, সেসব জায়গায় বাংলাদেশিরাই পরিচালনার কাজে যুক্ত হবে।’