নিজস্ব প্রতিবেদক: আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি উল্লেখ করেন, বিদেশ থেকে আসা বিনিয়োগকারীরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সম্মুখীন হয়ে এখানে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন।
ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ডিজেএফবি) আয়োজিত এক সেমিনার, প্রকাশনার মোড়ক উšে§াচন ও বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
ডিজেএফবির সভাপতি হুমায়ন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। ‘স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
আলোচনায় অংশ নেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন-আল-রশীদ, শরিফা বেগম এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আব্দুল বাকী।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধান পথ তিনটি। এগুলো হচ্ছে- বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্যের দিকে বিশেষ নজর দেয়া। পাশাপাশি নেগোশিয়েশন (আলোচনা) দক্ষতা বৃদ্ধির তাগিদ দেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘এ অঞ্চলে রাজনীতিবিদদের তুলনায় আমলারা অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী। আমাদের দেশেও আমলারা কর্তৃত্ববাদী। কেননা আমরা রাজনীতিবিদরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ফুলের মালা নিয়ে বসে থাকি। তাদের আহ্বান জানাই এদেশে এসে বিনিয়োগ করার জন্য। কিন্তু তারা যখন বিমানবন্দরে নামেন, তখন হয়রানির শিকার হন। তারা চান দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হোক, লাগেজটা স্বল্পতম সময়ে হাতে আসুক এবং যেন স্বাচ্ছন্দ্যে হোটেলে পৌঁছে বিশ্রাম নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এসে তারা এসব সুবিধা পান না। নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এছাড়া বিনিয়োগ করতে গিয়ে তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে যান। এ রকম উদাহরণ আরও আছে। আর এসব বিষয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়োজিত আমলাতন্ত্র।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের বলেন আসুন, বিনিয়োগ করুন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এসে আমলাতন্ত্রের কাছে মার খান।’
ডিজেএফবির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে দুই ক্যাটেগরিতে চারজনকে বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তরা হলেন- পত্রিকা ও অনলাইন ক্যাটেগরিতে সময়ের আলোর এম আর মাশফি ও বিজনেস পোস্টের রফিকুল ইসলাম। টেলিভিশন ও রেডিও ক্যাটেগরিতে এনটিভির হাসানুল শাওন এবং যমুনা টিভির তৌহিদ হোসেন পাপন। প্রত্যেককে ক্রেস্ট, সনদপত্র ও ২৫ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। এজন্য আমাদের দক্ষতা ও শ্রমিকের মান বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সবসময় বাজার নিয়ে কথা হয়। কিন্তু মাছের বাজার আর তেলের বাজার এক নয়। তেল অর্থাৎ জ্বালানি তেল ও অস্ত্রের বাজার বড় বাজার। এ বাজারের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা কম শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক বিষয়ও বটে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈষম্য কমাতে হবে। এটি করা না হলে টেকসই উত্তরণ সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাজার সুবিধা হারানো, স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ হাতছাড়া হবে। এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো- বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন। আমাদের আঞ্চলিক বাজারের দিকে নজর দিতে হবে। মধ্য আয়ের জার্নিতে সচেতন থাকতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। আমাদের বর্তমান বাজার সুবিধানির্ভর যে প্রতিযোগিতা আছে সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নির্ভর প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শোভন কর্মসংস্থান বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাথাপিছু আয়ের সুষম বণ্টন করতে হবে।’
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেগোশিয়েশন (দরকষাকষি) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মূল ভূমিকা নিতে হবে। কেননা এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। ভিয়েতনামকে আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কেননা বাণিজ্য ক্ষেত্রে তাদের কাছে অনেক কিছুই শেখার আছে। যেহেতু আমাদের খনিজ সম্পদ কম, তাই আমাদের ধনী হওয়ার একমাত্র পথ রপ্তানি বাড়ানো। আমাদের এফটিএ, পিটিএসহ নানা রকম বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। ইতোমধ্যেই এগুলো নিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। আমাদের আমদানি শুল্ক অনেক বেশি। এগুলো কমাতে হবে। সেই সঙ্গে বাণিজ্য অবকাঠামো সুবিধা আরও বাড়াতে হবে।
প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুতি ঠিক রাখতে হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর অন্যতম ইস্যু হচ্ছে প্রতিযোগিতা। সেটি ঠিকই আছে। এজন্য অবশ্যই দরকষাকষি বা আলোচনার দক্ষতা বাড়াতে হবে। আমাদের সমস্যা হলো, কিছু চাইতে হলে দিতে হবে। সেটি অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না। অর্থাৎ কোনো দেশ থেকে বাণিজ্য সুবিধা নিতে গেলে তাদেরও কিছু না কিছু সুবিধা দিতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের শুল্ক অনেক বেশি। সেগুলো কমানো দরকার। আমাদের পোশাক খাতে ভবিষ্যতে কাপড় আমদানি করে শুধু কেটে পোশাক রপ্তানি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের রিসাইক্লিংয়ে যেতে হবে।’