বিদেশের সঙ্গে লেনদেন আর্থিক হিসাবে ঘাটতি রেকর্ড সাত বিলিয়ন ছাড়াল

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও আর্থিক হিসাবে রেকর্ড ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আর্থিক হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ সাত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি ঋণ ছাড় কমে যাওয়া, সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এবং কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তা সময়মতো দেশে আসছে না। রপ্তানি আয় সময়মতো দেশে না আসাকেও আর্থিক হিসাবের ঘাটতির বড় একটি কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, কড়াকড়িসহ নানা পদক্ষেপে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ সময়ে বাংলাদেশের আমদানিতে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৬০২ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার। অন্যদিকে প্রথম সাত মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে তিন হাজার ১৩৯ কোটি ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল তিন হাজার ৬৩ কোটি ডলার। এতে বিদেশের সঙ্গে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার ৩৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। যদিও শুধু জানুয়ারিতে নতুন করে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৩১ কোটি ডলার।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ে ব্যবধান কমার সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে প্রথম সাত মাসে চলতি হিসাবে ৩১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত বজায় রয়েছে। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে প্রায় ৪৬৪ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল।

সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। তবে ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।

আর্থিক হিসাবে ঘাটতি আরও বেড়েছে: চলতি হিসাবে উদ্বৃত্তাবস্থা বজায় থাকলেও আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কমছেই না। উল্টো জানুয়ারিতে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ২১১ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আর্থিক হিসাবে ৭৩৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ঘাটতির পরিমাণ ৫২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যদিও নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি আট কোটি টাকা কমেছিল। মূলত গত বছরের ডিসেম্বরে আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ১২০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ সহায়তা এসেছে। ফলে আগের ঋণ পরিশোধের চাপ থাকার পরও আর্থিক হিসাব ঘাটতি কিছুটা কমেছিল।

তবে গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এ হিসাবে মাত্র ৮১ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল। আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বৃদ্ধির পেছনে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ কমে যাওয়া এবং আগের ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম সাত মাসের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময়ে আগের নেয়া ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ সময়ে নিট এফডিআই কমেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগও ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে, এর পরিমাণ ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি সামান্য বেড়েছে: আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি বজায় থাকায় প্রথম সাত মাসে সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৪৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে এই হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭৩৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে সার্বিক ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়লেও সাত মাসের হিসাবে কমে এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। প্রবাসী আয়ের অতিরিক্ত প্রণোদনা ও দামের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি তুলে নেয়ার পর প্রবাসী আয় বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ে ডলারের আগের দাম অব্যাহত আছে। ভিন্নভাবে আসার কারণে ডলারের দাম ভিন্ন হবে, তা তো হতে পারে না। এজন্য চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানির জন্য জাহাজে উঠছে, তার পুরো অর্থ দেশে আসছে না। যেটুকু প্রয়োজন, শুধু তাই আনছেন রপ্তানিকারকরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দাম ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দাম বাজারভিত্তিক করে দিলে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দূর হবে। আজ বা কাল এদিকে যেতেই হবে। তাই আগেভাগে যাওয়াই ভালো।’