২০১৫ সালে সারা দেশের পুকুর, দিঘি ও খালের জেলাভিত্তিক তালিকা প্রস্তুতপূর্বক সেগুলো পুনঃখননের প্রাথমিক পরিকল্পনা আঁটতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে মাঠপর্যায়ের তথ্য নিয়ে ৫৬ জেলার ৯২১টি খাল ও এক হাজার ৬১১টি পুকুর পুনঃখননের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) চূড়ান্ত হয়েছে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) উপস্থাপনের জন্য। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর, রংপুর ও দিনাজপুর জেলাকে বাইরে রাখা হলেও প্রকল্পটির উদ্দেশ্য মহৎ। বলা হয়েছেÑএর মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বন্যা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করা হবে। প্রস্তাবমতে, ছয় বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্পটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সারা দেশের ওইসব জলাশয়ের উন্নয়ন সাধিত হলে জনসাধারণের উপকার হয় বৈকি। ফলে প্রকল্প ঘিরে বিতর্ক নেই। তবে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন ওই প্রকল্পে ২৪ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণের যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সেটি নিয়ে। এ বিষয়ে গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘পুকুর খননেও বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি হয়তো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে।
উন্নয়ন শুধু নয়, সেবামূলক যে কোনো কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। আবার অনেক সময় বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়াটা আবশ্যিক হয়ে ওঠে মূলত দুটি কারণেÑএক. ওই বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ দেশি প্রশিক্ষক না থাকলে কিংবা দুই. যেখানে নির্দিষ্ট কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্নের জন্য আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা দরকার। আমাদের জানা নেই, আলোচ্য পুকুর ও খাল পুনঃখননমূলক প্রকল্পের বিদেশে প্রশিক্ষণ এ দুই ক্যাটাগরির কোনোটির আওতায় পড়ে কি না। এও ভাবনার বিষয়, যেখানে স্থানীয় কলাকৌশল ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই সারা দেশের পুকুর ও খাল খনন একদা সম্ভব হয়েছিল, সেখানে একই কাজে বিশ্বের অন্যত্র কি এমন অভাবনীয় প্রযুক্তি বা কলাকৌশলের প্রচলন হলো যে, প্রশিক্ষণ ছাড়া তা রপ্ত করা যাবে না? তা-ই যদি হয়, সেক্ষেত্রে কেবল ২৪ কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠিয়ে কার্যোদ্ধার হবে নাকি সারা দেশ থেকে হাজার হাজার পুকুর ও খাল খননকারীকে ওই প্রশিক্ষণে পাঠানো প্রয়োজনÑসেটি খতিয়ে দেখা দরকার। অপ্রয়োজনে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের নজির কম নেই। কিছুদিন আগে হাওরাঞ্চলে বন্যা চলাকালে আমরা সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে দেখেছি বিদেশ ভ্রমণরত। সে প্রশিক্ষণে তারা এতটাই ডুবে ছিলেন যে, হাওরের ফসল ভেসে গেলেও ঘটনাটি ঠিকমতো ঠাওর করে উঠতে নাকি সময় লেগেছে। যে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তাদের দক্ষ করে তোলার পরিবর্তে আত্মভোলা করে তোলে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বৈকি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পেলেও সমৃদ্ধির অজুহাতে অপচয়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়োজন। একনেক জাতীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল্যবান জায়গা। মেগা প্রজেক্ট না হলে সেখানে প্রতিটি প্রকল্পের বিস্তারিত আলোচনা দুষ্কর। আবার কর্মকর্তারা যদি অবহিত না করেন, সেসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। অথচ নানা প্রকল্পে একশ্রেণির কর্মকর্তার অপচয় বাতিক তথা ঘোড়ারোগের দাওয়াই প্রয়োগও আবশ্যক। এ অবস্থায় দাওয়াই দেওয়া হোক, তবে সেটি দিতে গিয়ে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ও জরুরি বিদেশি প্রশিক্ষণ যেন বাধার মুখে না পড়ে, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে।