বিদ্যালয়ের উন্নয়নে অংশীজনের ভূমিকা

মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। এখানে পড়াশোনা করছে প্রায় দুই কোটি ১৯ লাখ শিশু। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে আছে এই বিদ্যালয়গুলো। মানুষের দান করা ভূমিতেই গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। তারা সন্তানদের কথা চিন্তা করে এবং দেশের উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতের অগ্রগতির কথা ভেবেই এই জমিগুলো সরকারকে দিয়েছেন। স্বাধীনতার আগে ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাদের এই মূল্যবান সম্পত্তি দান না করলে হয়তো এত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত না।
প্রতিটি বিদ্যালয়েরই একটি নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্ট এরিয়া রয়েছে। শিশু জরিপের মাধ্যমে ৫+ থেকে ১০+ শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়। ক্যাচমেন্ট এরিয়ার কোনো শিশু যেন ভর্তির আওতার বাইরে না থাকে, কেউ যেন ঝরে না পড়ে বছরের শুরুতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ জরিপ চালানো হয়। ফলে প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শিশু ভর্তি হওয়ার পর তার পড়াশোনার সব দায়িত্ব সরকারের। বছরের শুরুতেই বিনা মূল্যে বই দেওয়া থেকে শুরু করে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান সবকিছুই সরকার করছে।
তাহলে সরকারকে সহযোগিতা করতে তথা বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ক্যাচমেন্ট এরিয়ার বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন পেশার যারা বসবাস করছেন, তাদের দায়িত্ব কি? আমরা মনে করি তাদের অনেক বেশি দায়িত্ব রয়েছে। প্রতি বছর বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঝখওচ (বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা), রুটিন মেইনটেন্যান্স, প্রাক-প্রাথমিক ক্ষুদ্র মেরামত, বৃহৎ মেরামত প্রভৃতি। প্রতিটি বিদ্যালয়েই ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। সাধারণত শিক্ষকরা এ কমিটির সহযোগিতায় সব বরাদ্দের অর্থ খরচ করে থাকেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করার কথা বলা আছে। মা সমাবেশ, গরিব শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, বিদ্যালয়ের সমস্যগুলো চিহ্নিত করে প্রাধিকারের ভিত্তিতে সিøপের অর্থ খরচ করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা-ই হয়।
এসব কাজে সহযোগিতার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামর্থ্যবানরা ইচ্ছা করলেই এগিয়ে আসতে পারেন, কারণ আমাদের সবারই উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা।
বিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে এবং সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনসমাজের সম্পৃক্ততা অতীব জরুরি। সরকার প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন করে দফতরি কাম প্রহরী দিচ্ছে। তাহলে কি আমাদের দায়িত্ব শেষ? আমরা মনে করি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে, চুরি হয়ে যাচ্ছে। এসব করে আমরা কার ক্ষতি করছি? আমরা দেশেরই ক্ষতি করছি এবং শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি।
শিক্ষকদের উচিত স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা, তাদের বিদ্যালয়ে উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা এবং মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ, উঠানবৈঠক, সিøপ স্টেকহোল্ডার মিটিং, সুধী সমাবেশ, বৃক্ষরোপণ, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ যাবতীয় অনুষ্ঠানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে সর্বসাধারণকে আমন্ত্রণ জানানো। এতে বিদ্যালয়ের প্রতি তাদের পজিটিভ ধারণা তৈরি হবে এবং তারা সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহী হবে।
২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের একটি পত্রের আলোকে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠনের কথা বলা হয়। এটি একটি যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। আজ যারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ভাঙা কুঁড়েঘর, টিনের চাল কিংবা গাছতলায় বসেই অনেকে প্রাথমিক স্তরের গণ্ডি পার করেছেন। তার পরও জীবনের প্রথম বিদ্যাপীঠের প্রতি রয়েছে তাদের নিরন্তর ভালোবাসা। এখনও অনেকেই ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে বিদ্যালয়ের আঙিনায় একটু ঘুরতে গিয়েই স্মৃতিকাতর হয়ে যান। স্পষ্ট মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে আমার প্রথম বিদ্যাপীঠ হায়দরগঞ্জ টিআরএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি মা সমাবেশে আমাকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের সহপাঠী ও প্রিয় শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদেই ফেলি।
এই আবেগ আর ভালোবাসাকে কাজে লাগাতে পারি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে। সাবেক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা নেওয়া যেতে পারে। হয়তোবা তাদের একটু সুদৃষ্টি বিদ্যালয়ের দৃশ্যপট পাল্টেই দিতে পারে। কোনো অনুষ্ঠানে সাবেক কীর্তিমানদের উপস্থিতি কিংবা গুণীজনদের সংবর্ধনা অনেকেরই ধারণা পরিবর্তন করে দেবে। তারা দেখে শিখবেÑঅমুকের সন্তান যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে বড় কিছু হয়, তাহলে আমার সন্তান পারবে না কেন? তাই আমাদের উচিত এই অংশীজন ও সাবেক শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো।
অংশীজনের সহায়তায় ঝরেপড়া রোধ, শতভাগ মিড ডে মিল বাস্তবায়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধ, শিশুশ্রম রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বিদ্যালয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা, গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থাসহ যাবতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে ‘আমাদের বিদ্যালয় আমরাই গড়ব’ এ সেøাগান বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার

naforhad.du@gmail.com