ইসমাইল আলী: সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ করেছে হাসিনা সরকার। অপরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয় আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের। তবে চাহিদা না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত এক দশকে কোনো বছরই সক্ষমতার অর্ধেকও চলেনি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র। বসিয়ে রেখে ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
অন্যদিকে ব্যয়বহুল এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করে বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ঘাটতি পূরণে পিডিবিকে নিয়মিত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তবে সর্বশেষ তিন অর্থবছর (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) ধরে এ খাতে ভর্তুকি চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেয়া হয়নি। এতে বকেয়া ভর্তুকি বেড়ে চলেছে।
হাসিনা সরকার পালিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকার ভর্তুকি বকেয়া রেখে গেছে। এর দায় চেপেছে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে। এছাড়া চলতি অর্থবছর বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করায় এ খাতে চাহিদা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর রেকর্ড ভর্তুকি দিতে হবে বিদ্যুৎ খাতে। অন্যথায় বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তবে বর্তমান সরকার এখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো পক্ষপাতী নয়।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয়ার অন্যতম শর্ত ছিল বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। তবে চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি বাড়িয়ে এ খাতে পুরোনো বকেয়া শূন্য করতে চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কয়েকটির চুক্তি ও বাকিগুলোর ট্যারিফ (দাম) পর্যালোচনায় কমিটি করা হয়েছে। এতে আগামীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোয় আশাবাদী সরকার।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। তবে ওই অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় চার হাজার ৫০৬ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেয়। এতে ওই অর্থবছর শেষে ৯৮০ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া থেকে যায়। পরের অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি দরকার ছিল সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় আট হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। তবে ওই অর্থবছর সাত হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে ওই অর্থবছর শেষে ৫১৪ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে ভর্তুকি। ২০১৯-২০ অর্থবছর ভর্তুকি দরকার ছিল সাত হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ওই অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় আট হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। তবে বরাদ্দ দেয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া পড়ে এক হাজার ২১ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি দরকার ছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ওই অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। তবে বরাদ্দ দেয়া হয় অনেক কম। মাত্র আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ায় ওই অর্থবছর শেষে বকেয়া পড়ে তিন হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এদিকে বিশ্ববাজারে কয়লা ও জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় ২০২১-২২ অর্থবছর ভর্তুকি চাহিদা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ওই অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। তবে সরকারের অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় ওই অর্থবছর বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এতে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
পরের বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও কয়লার মূল্য কমতে শুরু করে। তবে সার্বিকভাবে পুরো অর্থবছরের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আদানি, রামপালসহ নতুন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি চাহিদা ছিল ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ওই অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ৬০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। তবে বরাদ্দ দেয়া হয় ২৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম অনেকখানি কমায় হাসিনার ক্ষমতার শেষ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের বকেয়া ভর্তুকি যুক্ত হয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছর মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ৭০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। তবে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এতে গত অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের ভর্তুকি যুক্ত করলে মোট চাহিদা দাঁড়াবে ৭৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের শুরুতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৩৬ হাজার টাকা। এতে চলতি অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বাবদ ৩৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া থেকে যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬৬ হাজার কোটি টাকা করার চিন্তাভাবনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে বকেয়া ভর্তুকির চাপ অনেকটাই কমবে। তবে ভর্তুকির চাপ সামাল দিতে গিয়ে বাজেটে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।