বিদ্যুৎ উৎপাদনে অদক্ষ বেসরকারি খাত!

ইসমাইল আলী: ২০১৮-১৯ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৮৫১ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন কেন্দ্রে উৎপাদন করা হয় তিন হাজার ৪৫৯ কোটি ৬৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর বেসরকারি খাতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৭১৩ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বাকি ৬৭৮ কোটি ৯ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় ছিল সরকারি খাতে।
তথ্যমতে, গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গড় ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা ৬১ পয়সা। এর মধ্যে সরকারি কেন্দ্রগুলোতে গড়ে ব্যয় হয় চার টাকা চার পয়সা। বেসরকারি খাতে এ ব্যয় ছিল সাত টাকা ৬৬ পয়সা ও আমদানিতে ব্যয় হয় পাঁচ টাকা ৪৬ পয়সা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরাসরি ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। এর মধ্যে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম পড়ে ৩২-৩৩ টাকা। আর পিডিবি ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) থেকে ৪২ টাকা দরে ফার্নেস অয়েল কেনে। এতে বেসরকারি খাতের ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ব্যয় কম হচ্ছে।
যদিও জ্বালানি দক্ষতা কম ও উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে বেসরকারি খাতে গ্যাস ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ব্যয় পড়ছে অনেক বেশি। এর মধ্যে গত অর্থবছর ডিজেলচালিত কয়েকটি কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ৭২ থেকে ৮১ টাকা।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংস্থাটির কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় এক হাজার ৬৭১ কোটি ৭০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে মোট উৎপাদন ছিল এক হাজার ৩০৬ কোটি ১৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ১১৫ কোটি ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ৫৪ কোটি ৯২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বাকিটা উৎপাদিত হয় কয়লা, হাইড্রো ও বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে।
এদিকে পিডিবির কেন্দ্রগুলোতে গত অর্থবছর প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় গড়ে চার টাকা ৩০ পয়সা। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর গড় ব্যয় ছিল দুই টাকা ৩৩ পয়সা। ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোতে এ ব্যয় ছিল ১৭ টাকা আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ২২ টাকা ২০ পয়সা।
পিডিবি ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে রয়েছে আশুগঞ্জ পাওয়ার, ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন ও রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব কোম্পানি ২০১৮-১৯ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এক হাজার ৭৮৭ কোটি ৯৬ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে মোট উৎপাদন ছিল এক হাজার ৬৬৭ কোটি ৪৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো উৎপাদন হয় ৭২ কোটি ৮৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
রাষ্ট্রায়ত্ত এসব কোম্পানির তেলচালিত কেন্দ্রগুলো পিডিবির চেয়েও দক্ষ। এসব কেন্দ্রে গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয় ১৫ টাকা ৫০ পয়সা আর ডিজেলে ২০ টাকা ৭১ পয়সা। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয় দুই টাকা ৭২ পয়সা। সার্বিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব কোম্পানির আওতায় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়ে তিন টাকা ৮০ পয়সা।
এদিকে বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদে লাইসেন্স দেওয়া ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারগুলোতে (আইপিপি) ২০১৮-১৯ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় দুই হাজার ১১৬ কোটি ৭২ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে মোট উৎপাদন ছিল এক হাজার ৩৪৯ কোটি ৩৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ৭০১ কোটি ৬৭ লাখ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ৬২ কোটি আট লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বাকিটা ছিল সৌরবিদ্যুৎ।
এসব আইপিপি কেন্দ্রগুলোতে গত অর্থবছর প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় ছিল গড়ে সাত টাকা ৪৫ পয়সা। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয় দুই টাকা ৯২ পয়সা। ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোতে এ ব্যয় ছিল ১৩ টাকা আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ৪২ টাকা ১৯ পয়সা।
সূত্রমতে, বেসরকারিতে এক দশক আগে রেন্টাল বিভিন্ন কেন্দ্র অনুমোদন দেয় সরকার। স্বল্পমেয়াদি এসব কেন্দ্রের অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও বেশকিছুর চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। এতে রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকেও বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে। যদিও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে অদক্ষ।
পিডিবির তথ্যমতে, রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৫৯৬ কোটি ৫৮ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে মোট উৎপাদন ছিল ৩৫৮ কোটি ১১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ২২৭ কোটি চার লাখ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ১১ কোটি ৪৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে গত অর্থবছর প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় গড়ে আট টাকা ৪১ পয়সা। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয় তিন টাকা ৮৯ পয়সা। ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোতে এ ব্যয় ছিল ১৪ টাকা ৮৪ পয়সা আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোতে ২২ টাকা ১৬ পয়সা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম বলেন, বেশিরভাগ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ঠিকমতো দরকষাকষি করা হয়নি। এগুলোর চুক্তিতেও সমস্যা আছে। ফলে কেন্দ্র বসিয়ে রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়। এছাড়া রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশকিছুর জ্বালানি দক্ষতা অনেক কম। এজন্য বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এত বেশি। এগুলো বন্ধ না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে আইপিপি কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ছয় হাজার ৬০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আর রেন্টাল খাতে দুই হাজার ১১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।