বিদ্যুৎ খাতে বাড়ছে কয়লার দাপট পিছিয়ে পড়ছে ফার্নেস অয়েল

ইসমাইল আলী:বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে ২০০৯ সাল থেকে রেন্টাল-কুইক রেন্টালে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। অনুমোদন দেয়া হয় তেলভিত্তিক (ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত) ছোট বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১২ সালের পর তেলভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রও অনুমোদন দেয়া শুরু করে সরকার। তবে ২০১৬ সাল থেকে তেলের চেয়ে কয়লাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়। এতে বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে কয়লার দাপট বাড়ছে।

বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ক্রমশ কমতে থাকায় গত অর্থবছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আর ডলার সংকটে তেল আমদানি করতে না পারায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল বেশিরভাগ সময়। এতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানিতে।

গত দুই অর্থবছরের আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর কয়লা আমদানি হয়েছিল ২৯ লাখ ১৪ হাজার ৬৬৫ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ লাখ ২৬ হাজার ১৫৪ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ গত অর্থবছর কয়লা আমদানি বেড়েছে ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৮৯ মেট্রিক টন বা প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বিদায়ী অর্থবছর ফার্নেস অয়েল আমদানি হয়েছে ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৫১৬ মেট্রিক টন, আগের অর্থবছর যা ছিল ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েল আমদানি কমেছে ১২ লাখ ১৪ হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন বা ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

সূত্রমতে, গত অর্থবছর দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রের ছিল ২৮ শতাংশ। বর্তমানে তা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। যদিও বর্তমানে কয়লাচালিত কেন্দ্রের সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশ। গত অর্থবছর তা ছিল ৮ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছর অর্থায়ন সংকট ও পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধে বিলম্ব করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক চাহিদামতো তেল আমদানি করতে পারেনি। ফলে সক্ষমতা থাকলেও সেগুলো বসে ছিল।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৩৯৩ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ছয় দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় এক দশমিক ৭৭ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

গত অর্থবছর বিদ্যুতের উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ১৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় দুই দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় (আদানিসহ) ১২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।

এ হিসাবে গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমেছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে আট দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

এদিকে চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ দুই দশমিক ৫৪ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ২৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হবে (আদানিসহ) ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এ হিসাবে চলতি অর্থবছর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রে উৎপাদন কমবে এক দশমিক ৯৫ শতাংশ। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।

তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমার কারণে চলতি অর্থবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা অনেক কমে যাবে। এক্ষেত্রে গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছিল ৩২৯ কোটি লিটার ও ডিজেল ৪০ কোটি লিটার। চলতি অর্থবছর তা কমে দাঁড়াবে ফার্নেস অয়েল ৫৪ কোটি লিটার ও ডিজেল ২ কোটি লিটার।

ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমার প্রভাব পড়বে এগুলোর উৎপাদন ব্যয়ে। এ ধরনের কেন্দ্রগুলোয় গড় উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে। পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস অয়েলে ব্যয় ছিল ১৬ টাকা ৯৬ পয়সা ও ডিজেলে ৩৪ টাকা ৩৬ পয়সা। গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলে ব্যয় দাঁড়ায় ২২ টাকা ২৬ পয়সা ও ডিজেলে ৩৪ টাকা ২২ পয়সা। আর চলতি অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস অয়েলে ব্যয় পড়বে ৪৬ টাকা ৮৯ পয়সা ও ডিজেলে ৮৯ টাকা পাঁচ পয়সা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমিয়ে আনায় ওই দুই খাতে গড় ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। কারণ বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর ফলে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাবে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। যদিও কয়লাচালিত ও আমদানি বিদ্যুতে গড় ব্যয় কমবে না। বরং উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার উচ্চ দামের কারণে আগামীতে এ দুই ধরনের বিদ্যুৎ কেনায়ও ব্যয় বাড়বে।