বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত: দৃশ্যমান সংকটের চেয়েও বাস্তব অবস্থা অনেক বেশি জটিল!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: অপরিশোধিত তেলের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বাজারের (ইউএস ডব্লিউটিআই ক্রুড) মূল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বিগত এক বছরে ব্যারেল প্রতি মূল্য ৬৮ ডলার থেকে ১২০ ডলারে ওঠানামা করেছে। ব্রেন্ট ক্রুড মার্কেটেও দাম কাছাকাছি, মাত্র তিন-চার ডলারের হেরফের। গড়ে হিসেবে বিগত বছরে মূল্য আনুমানিক ৮৪-৮৫ ডলার ছিল, গত নভেম্বর থেকে এক বছরে গড়ে মূল্য বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ১২-১৫ শতাংশ। ইউক্রেনে হামলার মুহূর্তে অল্প সময়ের জন্য ১২০ ডলারে উঠে আবার কমেও এসেছে।

বিপরীতে বাংলাদেশে ডিজেলের দাম নভেম্বরে ২৩ এবং আগস্টে সাড়ে ৪২ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরের কম সময়, অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসে সাড়ে ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ এই বছরে তেলের দাম একবার ব্যারেলে ৬৫ ডলার এবং আরেকবার ৮০ ডলারে নেমেছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমেনি।

যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ে সরকার দেশে প্রাইমারি জ্বালানি (ডিজেল ফার্নেস গ্যাস কয়লা) ইত্যাদির দাম বাড়ায়। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাথমিক জ্বালানির মূল্য স্থির থাকে বা কমে তখন সরকার দেশে সেকেন্ডারি জ্বালানি অর্থাৎ বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। ১২ বছরে বিদ্যুতের দাম অন্তত নয় বার বেড়েছে, এই সময় ডিজেলের দাম ২৬ টাকা থেকে ১০৯ টাকা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৯ থেকে সর্বোচ্চ ৯২ ডলার। অর্থাৎ লিটারপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম মাত্র ৫৬-৫৭ টাকা। এক ব্যারেল (১৫৯ লিটার) অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধন করে ৭৩ লিটার পেট্রোল, ৩৬ লিটার ডিজেল, ২০ লিটার জেট ফুয়েল ও হেভি ফুয়েল, ৬ লিটার প্রোপেন এবং ২৪ লিটার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পেট্রোলিয়াম পণ্য তৈরি হয়। তেল শোধনে লিটারে খরচ পড়ে দেড় থেকে আড়াই টাকা। শোধন, পরিবহন ও কিছু সিস্টেম-লস মিলে লিটারে খরচ সর্বোচ্চ ৬২-৬৫ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লভ্যাংশ, সরকারের কর, শুল্ক, ভ্যাট-এই চার স্তরের মুনাফার পরে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রোল ১২৫ এবং অকটেন ১৩০ টাকা। অর্থাৎ ১ ব্যারেল অপরিশোধিত তেলে সর্বোচ্চ ১১-১২ হাজার টাকা খরচ করে সেটা বিক্রি করা হচ্ছে ২১-২২ হাজার টাকার কাছাকাছি। কিন্তু তথাপি সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লোকসান করছে, কখনও কখনও দিনেই ১০০ কোটির বেশি লোকসান (যেমন জুলাইয়ে), কেন?

এক. আনুকূল্য পাওয়া বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেট ভারীর জন্য লুটেরা চুক্তির ফাঁদ। এসব চুক্তিতে ৫ টাকার বিদ্যুৎ ৭, ৯, ১২, ১৫, ২২ এরকম যথেচ্ছা দামে নির্ধারিত হয়েছে। যে কোম্পানি যা পেরেছে বাগিয়ে নিয়েছে, কোনো বিধিবদ্ধ নীতিমালা ছিল না। বরং দায়মুক্তির আইন আছে বলে বিদ্যুৎ খাতের অপচুক্তি ও অপখরচ জবাবদিহিহীনতার ঊর্ধ্বে। উপরন্তু বেসরকারি বেজ লোড কেন্দ্রগুলো ঠিক সময়ে উৎপাদনে আসেনি।

দায়মুক্তির আইনটি হলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) আইন, ২০১২-২০২৬’। ‘আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ’ উপশিরোনামে আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ উপশিরোনামে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যেও জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’ ‘এই আইনের অধীন গৃহীত কাজের হেফাজত’ উপশিরোনামে ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই আইনের অধীন কৃত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থা এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে ও পরিচালিত হইবে যেন এই আইনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি।’

দুই. ক্যাপাসিটি চার্জ, ১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, কোনো রূপ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই। অথচ জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের সময় অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল করাই যায়নি। অর্থাৎ এসব কেন্দ্রের সক্ষমতা এক দিকে বাড়িয়ে দেখানো, অন্যদিকে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনেও অক্ষম। শেয়ার বিজের প্রতিবেদন মতে, বিদ্যুৎ বিক্রির টাকাতো পেয়েছেই, উপরন্তু উৎপাদন না করেও শুধু অলস কেন্দ্রের জন্যই অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সামিট পাওয়ার, সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা নিয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার, প্রায় সোয়া চার হাজার কোটির বেশি টাকা নিয়েছে বাংলা-ক্যাট। ইউনিটপ্রতি অনেক বেশি দামে বিক্রি, ক্যাপাসিটি চার্জ, আমদানিতে শুল্ক ছাড়, সহজ সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা, জমি ক্রয়ে সুবিধা-কি পায়নি তারা! 

এক-দুটি নয় বহু, সভরেন গ্যারান্টি দেয়া আছে তাদের। সাধারণত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কিছুটা বেশি দামের নিশ্চয়তা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতাকে শর্ত হিসেবে রেখে বিনিয়োগ করতে চায়। দীর্ঘ সময় সচল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ দিতে মেইনটেনেন্স সময়ে দেয়া হয় ওভারহোলিং চার্জ। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি ও ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে তৃতীয় পক্ষহীন চুক্তিতে তিন থেকে পাঁচগুণ দামের নিশ্চয়তা দেয়া আছে। আছে ক্যাপাসিটি চার্জ, ওভারহোলিং চার্জ, তেল আমদানি প্রণোদনা, কর অবকাশ সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ বহু সভরেন গ্যারান্টি। আছে সহজ শর্তের ঋণের সুবিধাও। তারা জমি ক্রয়ে রেজিস্ট্রি কর মওকুফ করার সুবিধাও চেয়েছিল, মোট বিনিয়োগের অন্তত ১০ শতাংশ মূল্যের খুচরা যন্ত্রপাতিরও করমুক্ত আমদানি সুবিধা চেয়েছিল তারা। বিপিসির আমদানি করা তেলের মান নিয়ে প্রশ্ন (যদিও তা পরীক্ষিত) তুলে সেখানেও নতুন প্রণোদনা চেয়েছে তারা। এমনকি ২০০৬ সালের শ্রম আইনের কর-পূর্ব মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রাখার বিধানের সংশোধনও।

একদিকে দায়মুক্তি এবং অন্যদিকে বহু সভ্রেণ গ্যারান্টি দিয়ে এভাবে রাষ্ট্রের বাজেট ও ডলার ড্রেইনের একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থাটা সরকারের আইনি মদদেই করা হয়েছে।

তিন. ওপেক, ওপেক প্লাস দেশগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনার বৃহৎও স্থায়ী সরবরাহ চুক্তি নেই। বরং বড় তেল উৎপাদনকারী নয় এমন দেশ যেমন চীন ভারত ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে জ্বালানি চুক্তি করেছে সরকার। অর্থাৎ জ্বালানি নিরাপত্তার সার্বিক কোনো বোধগম্যতা আসেনি।

চার. স্পষ্ট মার্কেট থেকে মোট তেল গ্যাস আমদানির ৫০ শতাংশ করার কমিশনবান্ধব বাজে সিদ্ধান্ত। দুঃখজনকভাবে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে কিছু কমিশনখোর দালালের হাতে বিক্রি করা হয়েছে, যে জ্বালানির নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো নিয়মিত যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত!

পাঁচ. অতীতে কাতার ও ওমান বড় গ্যাস সরবারহ চুক্তির জন্য সরকারকে বলেছিল, স্পট মার্কেটের কমিশন খাওয়ার লোভে সেটা করেনি সরকার। এখন কাতার-ওমানের গ্যাস পেতে কূটনৈতিক চ্যানেলে আবেদন জানানো হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশকে গ্যাস দেয়ার সুযোগ নেই, তারা ইউরোপসহ রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করা শক্তিমান দেশে গ্যাস বিক্রি শুরু করেছে।

এদিকে সমুদ্রসীমা জয়ের ১০ বছর হতে চললেও সমুদ্রের কোনো ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান করেনি, যদিও যৌথ ব্লকের ওপারে মিয়ানমার গ্যাস পেয়েছে। সর্বক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতা, তদবির ও লুটের সস্তা ধান্দা স্পষ্ট।

পায়রা ও রামপালে ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’র নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে একদিকে নেই বড় বড় শহর বন্দর ইপিজেড বা লোড সেন্টার, ফলে সঞ্চালনের সীমাবদ্ধতার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি স্বল্প ব্যবহƒত। যে উচ্চমান কয়লার কথা ইটিপিতে বলা হয়েছিল, তা আমদানি করতে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি। ফলে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কেন্দ্রে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নিন্মমানের ভারতীয় কয়লা ব্যবহার হচ্ছে, যেখানে ভারত নিজেই উচ্চমান কয়লা আমদানি করে।  

ছয়. রাশিয়া থেকে বড় পরিসরে তেল কিনতে চেয়েছিল সরকার, কমিশনের ধান্দায় পরিমাণ কমানোয় রাশিয়া বিরক্ত হয়ে ছোট পরিসরে তেল বিক্রি করবে না বলে মানা করে দিয়েছে। ভারতে পরিশোধিত করে ভায়া হয়ে রাশিয়ার তেল কেনার যথেষ্ট উদ্যোগও দেখা যায়নি।

সাত. পায়রায় কয়লা বিদ্যুৎ জন্য যে দামে কয়লা কিনছে তার দ্বিগুণ দামে আদানি ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে কয়লা সরবরাহের চুক্তি করে বসে আছে (২৩৭ ডলারের বিপরীতে ৪৩৪)। চুক্তির ভুলে মাসে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা গচ্চার আশঙ্কা পিডিবির (শেয়ার বিজ প্রতিবেদন)!

এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৯-৯২ ডলার ব্যারেল প্রতি। কিন্তু ডলার সংকটে সরকার কিনতে তেল গ্যাস কিনতে পারছে না। বিদ্যমান সরবারহ চুক্তিগুলো ছোট বলে জ্বালানি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। স্পটমার্কেটে আন্তর্জাতিক বাজার দর থেকে আরও বেশি, কমিশনের কারণে স্পট মার্কেটের দাম থেকেও সরকারের ক্রয় মূল্য আরও বেশি পড়ে। হাতে ডলার নেই, এক বছরে আমদানি ও রপ্তানির ঘাটতি অন্তত ৩৩ বিলিয়ন ডলার। 

সরকার অপেক্ষা করছে শীতের জন্য, তখন বিদ্যুৎ চাহিদা স্বাভাবিকভাবে কমে আসে। কিন্তু শীতে যদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ভয়াবহ অবস্থায় যায়, মন্দার ভয়ে ওপেক রাষ্ট্রগুলো তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয়, তাহলে তেলের দাম নাও কমতে পারে। মন্দার কারণে প্রবাসী আয় কমলে, ডলার সংকটও বাড়বে। ফলে শীত এলেই যে বিদ্যুৎ সংকট চলে যাবে, তেমন ভাবার নিশ্চিত কারণ নেই। হ্যাঁ, পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হবে। এটা সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়। বরং ভয় হয় মার্চ-এপ্রিলে আবার যখন গরম ফিরবে, তখন কী হবে?

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কিনতে না পেরে, জ্বালানি কম কিনে ডলার সেভ করতে শুরু করছে, পরিকল্পতি লোডশেডিং। লোডশেডিং শুরু হয়েছে ১ ঘণ্টা দিয়ে, এখন ৫-৬ ঘণ্টায় পৌঁছেছে। লোডশেডিং করতে গিয়ে দেখা গেল, বিদ্যুৎ গ্রিড স্মার্ট না। অটোমেশন না করে সেখানেও পরিকল্পনাহীন কাজ হয়েছে। বিদ্যুৎ অটোমেশনের কাজ দেয়া হয়েছে নিন্মমানের কোম্পানিকে। শ’খানেক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাজার হাজার সাবস্টেশন স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণের স্ক্যাডা সেন্টারে সংযুক্ত নেই, অর্থাৎ অটোমেশনে নেই। পুরোনো সমস্যা ছিল গ্রীষ্মে প্রায় ২০ হাজার ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড ছিল!  

ফলে দূরনিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোড কমানো যায় না, বরং ফোনে নির্দেশ দিয়ে ম্যানুয়াল লোডশেড করতে হয়। এরকম ‘ম্যানুয়াল’ লোডেশেডের সঙ্গে উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়ে, বেসরকারি বহু কেন্দ্র স্ক্যাডা ও লোড ডিস্প্যাচ সেন্টারে সংযুক্ত নেই বলে এগুলো স্বয়ংক্রিয় বন্ধ ও সচল করা যায় না। সমস্যা বহুমুখী, এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হয়ে গেছে এক বছরে দু’বার।

বিএনপির সময়ে বিনিয়োগ না পেয়ে, বেসরকারি খাতকে কিছুটা বেশি মুনাফা করতে না দেওয়ার নীতিগত ভুলে, সরকারি বিনিয়োগ না করায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যায়নি, কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে গ্রামে সঞ্চালন বাড়িয়ে শহরে লোডশেডিং তীব্র করেছে। মানুষ খাম্বা তারেক (মেসার্স খাম্বা লিমিটেড) বলে ব্যাপক গালাগালি ও ট্রল করেছে।

আওয়ামী লীগের ১৪ বছরে প্রাথমিক জ্বালানি পরিকল্পনা ঠিক না করে, বিতরণ ঠিকঠাক না বাড়িয়ে, সঞ্চালনে ভুল শিল্প পরিকল্পনা করে, সমন্বয়হীন উৎপাদন বাড়ানোর নামে লুটের মহাআয়োজন হয়েছে। চলমান অর্থবছরেও উৎপাদনে বিদ্যুৎ বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ বিপরীতে বিতরণে ২০ শতাংশ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গেছে  উৎপাদনের নামে, কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানি কীভাবে আসবে তার কোনো চিন্তা ছিল না। করা হয়নি সবুজ বিদ্যুৎ পরিকল্পনাও।

২০০৬-২০২২, ১৬ বছরের আগে ও পরে বিদ্যুতের ‘জড়’ খাম্বাগুলোর অভিজ্ঞতা একই। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের অভাবে খাম্বায় ঝুলানো তারে বিদ্যুৎ ছিল না দিনের ৫-৬-৭ ঘণ্টা, এখন জ্বালানি তেল গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ থাকে না ৪-৬ ঘণ্টা। বহু রিমোট ও দ্বীপ এলাকায় সাবমেরিন সঞ্চালনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ নেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে যাওয়ার কথা ছিল নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ এবং থাকার কথা ছিল স্থানীয়ভাবে ব্যক্তি বিনিয়োগে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রির কমিউনিটি গ্রিড। অর্থাৎ উৎপাদনের বিপরীতে সঞ্চালন, সঞ্চালনের বিপরীতে বিতরণের পরিকল্পনাহীনতার কী করুণ ব্যবস্থা! বাংলাদেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অযোগ্যতার কী দীর্ঘ মিছিল! 

বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা কোনোকালেই টেকসই ছিল না। সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের পরে বিদ্যুৎ আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ উন্নয়ন ব্যয়ের খাত হয়েও বিদ্যুৎ খাত টেকসই করা যায়নি বরং কিছু মাফিয়া অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। চুক্তির ফাঁকে ও ফাঁদে আটক দেখিয়ে আদতে আওয়ামী লীগের লোকেরাই কৌশলে সরকারের বাজেট সংকট তৈরি করেছে। সব মিলে যা দেখা যায় তার চেয়েও বাস্তব সংকটের গভীরতা বেশি।

ক. তেল-গ্যাস আমদানির বড় ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চুক্তি নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাইমারি ফুয়েল সাপ্লাই গ্যারান্টি নেই। অর্থাৎ জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে;

খ. আমদানি ও রপ্তানির ঘাটতি বা ট্রেড ডেফিসিট মাত্রাতিরিক্ত বলে প্রাথমিক জ্বালানি কেনার পর্যাপ্ত ডলার নেই। প্রত্যাশিত বিশ্বমন্দা এবং মূল্যস্ফীতিতে বাংলাদেশের অতি আমাদানিনির্ভরতা থেকে যাবে বলে ডলার সংকট শিগগিরই কেটে যাচ্ছে না;

গ. সবুজ জ্বালানি মাত্র ৪ শতাংশ, রূপপুরের বাইরে দৃশ্যমান নন-নিউক্লিয়ার নিরাপদ সবুজ জ্বালানি পরিকল্পনা নেই। আজকে সবুজ বিদ্যুতের পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়ন করা থাকলেও, প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির চাপ অনেক কম হতো;

ঘ. সাগরের মীমাংসিত ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের আন্তরিক আয়োজন নেই। সরকার নিজের করা টেন্ডার বাতিল করেছে। নিজস্ব কয়লা উত্তোলনে উম্মুক্ত পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেই, বরং এশিয়া এনার্জির মতো অযোগ্য কোম্পানিকে দিয়ে রাখা হয়েছে নিজস্ব কয়লা খনি;

ঙ. বিশাল বিনিয়োগ সাপেক্ষ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সেকেলে, আনস্মার্ট, স্বয়ংক্রিয় সুবিধার বাইরে;

চ. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ফিজিবল না। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে আসতে বহু সময় লাগবে বলে সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বল্প ব্যবহƒত থাকবে। উপরন্তু সেসব লোডসেন্টার থেকে বহু দূরে বলে সঞ্চালন লাইনের পেছনে বিশাল অর্থ চলে গেছে। রূপপুরও লোড সেন্টার থেকে দূরে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে শিল্প স্থাপন, ব্যবসা ও নগর বিকাশ ও লোড তৈরির পরিকল্পনা সমন্বিত করা যায়নি বা হয়নি। অনেকগুলো পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে, যেগুলো নন ফাংশনাল, কিন্তু সেখানে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা আছে। অর্থাৎ বিশাল বিশাল বিনিয়োগের রিটার্ন নগণ্য;

ছ. আরও দুটি অদৃশ্য কিন্তু গভীর সমস্যা হচ্ছে, জ্বালানি অদক্ষতার সমস্যা (অতি-নিন্ম প্লান্ট ফ্যাক্টর ও প্লান্ট ইফিশিয়েন্সি)। অন্তত ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র অডিট করে বের করা যাবে যেগুলোর জ্বালানি দক্ষতা ৩০ শতাংশের  কম, অর্থাৎ অনেক বেশি জ্বালানি পুড়ে খুব কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বহু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর কম বলে একটানা সচল থাকতে পারে না। বড় সমস্যা ক্যাপটিভ। শিল্পবিদ্যুতের দাম বেশি বলে ব্যক্তি মালিকানায় চার-পাঁচ হাজার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। সার্টিফিকেট অরিজিন নকল করে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে আনা মেয়াদোত্তীর্ণ ও চরম জ্বালনি অদক্ষ এসব প্লান্ট বিদ্যুৎ খাতের গলার ফাঁস। দেশে লোডশেডিং যত বাড়বে, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র তত বেশি চলবে, ততই জ্বালানি অপচয়ের সমস্যাও প্রকট হবে। 

এদিকে শিল্প বিদ্যুতের জন্য বিদ্যুৎ বিলের পলিসিও ভুল। একদিকে চুরিকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দেয়া হয়, অন্যদিকে শিল্প বিদ্যুতের দাম বেশি বলে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা নেই বলে (হঠাৎ লোডশেডিং হয়, যা শিল্পের জন্য বিপর্যয়কর) ক্যাপটিভে চলে গেছে মাঝারি থেকে বড় শিল্প। শিল্প মালিকরা দাবি করেন, নিজস্ব গ্যাস জেনারেটরে উৎপাদন খরচ সরকারি মূল্যের মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ পড়ে (অবশ্য এখানে গ্যাসের মিটার ইউনিট চুরি ও ঘুষের বিষয় জড়িত আছে)। সরকারি শিল্প বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য একদিকে শিল্প পণ্য উৎপাদনের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে ক্যাপটিভের নি¤œ দক্ষতার জেনারেটরে বেশি জ্বালানি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় বলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বেশি জ্বালানি আমদানিতে ডলার ড্রেইনও হচ্ছে;

জ. জাতীয় গ্রিড স্মার্ট নয়। ন্যাশনাল লোড ডিস্প্যাচ সেন্টারের সক্ষমতা কম, স্ক্যাডা সিস্টেম পুরোনো। বিদ্যুৎ খাতে নেই পর্যাপ্ত কারিগরিভাবে দক্ষ জনবল। উৎপাদন ঘাটতিজনিত গ্রিড বিপর্যয়ে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সিজনিত ট্রিপ সামাল দেয়ার সক্ষমতা অটো-লোডশেডিং সিস্টেমের নেই, আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি প্রোটেকশন সিস্টেমের সক্ষমতা সীমিত। পাশাপাশি আরেকটি উপলব্ধি পূর্ব-পশ্চিমের গ্রিডে বিদ্যুৎ চাহিদা বিন্যাসে সমন্বয় নেই। পশ্চিম গ্রিডে শিল্পায়ন পরিকল্পনার সমন্বয় নেই বলে পূর্বে চাপ বেশি। পূর্ব গ্রিডে লোড সেন্টারের কাছাকাছি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র কম। তাহলে অর্জন কী! অর্জন হচ্ছে ভুলভাল ও মিথ্যা সক্ষমতার অর্ধশত বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থাৎ হার্ডওয়্যার। যেগুলো আজ তেল গ্যাস কয়লার অভাবে বন্ধ। যেগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে দেখানো। বসে থেকেও যারা রাষ্ট্রের অর্থ লুটে নিচ্ছে;

ঝ. শেষের সমস্যা হচ্ছে, এসব চুক্তির জঞ্জাল সরানো। ২০২৩-এর পরে আওয়ামী লীগ থেকে গেলেও এসব অযৌক্তিক ও অন্যায্য লুটেরা চুক্তি দেশের জন্য, আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য গলার কাঁটা। নতুন সরকার এলেও এসব জঞ্জাল সরানো এবং বিদ্যুৎ খাতে নতুন বিনিয়োগ আনা কষ্টের বিষয় হবে।  

প্রায় অর্ধশত বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেয়া অযৌক্তিক অন্যায্য শর্তের (বাজেট ড্রেনিং) বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি বাদ দিয়ে, নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, সঞ্চালন ও বিতরণে বিনিয়োগ করা, সবুজ বিদ্যুৎ বিনিয়োগ আনা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম অটোমেটেড করতে বিনিয়োগ আনা চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ কিন্তু করা হয়েছে, ভুল জায়গায় ও ভুল হাতে।

তড়িৎ প্রকৌশলী, বুয়েট। টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।

গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য

faiz.taiyeb@gmail.com