ভুলে ভরা প্রতিবেদন

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের তথ্যে এক বছরে ভুল ১০৬০টি

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে নানা অনিয়মের তথ্য বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে বহুবার। এ খাতের তথ্যেও রয়েছে নানা ধরনের ঘাটতি। তবে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের নানা ভুল তথ্য প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। গত (২০২১-২২) অর্থবছর এ ধরনের ভুল তথ্য প্রকাশের সংখ্যা এক হাজার ৬০টি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতেই ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এক হাজারের বেশি। অথচ চলতি বছর বিদ্যুৎ বিভাগকে দেয়া হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২২’।

বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা-বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) প্রকাশিত ‘এনার্জি ডেটা ম্যানেজমেন্ট: চ্যালেঞ্জেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের ভুলের তথ্য বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

এতে দেখানো হয়েছে, গত অর্থবছর বিভিন্ন কেন্দ্র্রে সক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে এক হাজার ১৩ বার। এর মাধ্যমে প্রায় ৪৬ কোটি ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন দেখানো হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য ৩৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর উৎপাদনের চেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ দেখানো হয়েছে ৪৭ বার। এর পরিমাণ দুই হাজার ২৪১ দশমিক ৫৮ এমএমএসসিএফ। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভুলের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গত জুলাইয়ের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২২ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। তবে পিডিবির দৈনিক উৎপাদন প্রতিবেদনের হিসাবমতে, জুনে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ মাসিক প্রতিবেদনে উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৮৬ মেগাওয়াট বেশি দেখানো হয়েছে।

এদিকে পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৪২ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। তবে পিডিবির সারাবছরের দৈনিক প্রতিবেদনের তথ্য যোগ করে দেখানো হয়, ওই অর্থবছর সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল আট হাজার ২৯ কোটি ৪৮ লাখ ইউনিট। অর্থাৎ ১২ কোটি ৮২ লাখ ইউনিট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সাধারণত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার সর্বোচ্চ শতভাগ উৎপাদন করতে পারে। তবে কোনো কোনো সময় পূর্ণ ক্ষমতায় পরিচালনা করলে তা সক্ষমতার ১০৮ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদনে সক্ষম। যদিও স্বাভাবিকভাবে সক্ষমতার ছয় থেকে আট শতাংশ কম উৎপাদন করা হয়। তবে গত অর্থবছর এক হাজার ১৩ বার সক্ষমতার চেয়ে বেশি উৎপাদন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি উৎপাদন দেখানো হয়েছে কোনো কোনো কেন্দ্রে। এমনকি একবার সক্ষমতার ২০ গুণ বেশি উৎপাদনও দেখানো হয়েছে।

ভুলের ধরন বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, গত অর্থবছর সক্ষমতার ১০০-১০৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে ৯৩৩ বার। এছাড়া ১০৯-১৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে ৫৬ বার, ১৫১-২০০ শতাংশ দেখানো হয়েছে চারবার, ২০১-৩০০ শতাংশ দেখানো হয়েছে তিনবার, ৩০১-৪০০ শতাংশ দুইবার এবং ৪০১-৫০০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে একবার।

সক্ষমতার ৫০১-৭০০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে তিনবার, ৭০১-১০০০ শতাংশ উৎপাদন দেখানো হয়েছে ছয়বার, ১০০১-১৫০০ শতাংশ দেখানো হয়েছে দুবার, ১৫০১-২০০০ শতাংশ দেখানো হয়েছে দুবার এবং ২০০০ শতাংশের বেশি উৎপাদন দেখানো হয়েছে একবার।

প্রতিবেদনটির প্রণেতা বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি দুই লিটারের বোতলে স্বাভাবিকভাবে সর্বোচ্চ দুই লিটার তরল পদার্থ ধরবে। তবে দৈনিক প্রতিবেদন প্রণয়নকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দেখাচ্ছে দুই লিটারের পানির বোতল তিন থেকে চার লিটার পর্যন্ত পানি ধারণ করেছে। এমনি ম্যাজিক্যালি দুই লিটারের বোতলে ১০ লিটারের বেশি পানি ভরা হয়েছে, যা পুরোপুরি অসম্ভব বিষয়।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫৩ বার সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন দেখানো হয়েছে। সেটি হলো ‘এক্স ইনডেক্স’ কোম্পানির মালিকানাধীন টাঙ্গাইলের ২২ মেগাওয়াট গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্রটিতে প্রতিবারই সক্ষমতার চেয়ে ১০৯-১৫০ শতাংশ উৎপাদন দেখানো হয়েছে। এরপর সবচেয়ে বেশিবার ভুল উৎপাদনের তথ্য দেখানো হয়েছে তিনটি কেন্দ্রে। এগুলো হলোÑগাজীপুরের ১০৭ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলচালিত আরপিসিএলের কেন্দ্র, আশুগঞ্জের ২২৫ মেগাওয়াট গ্যাসচালিত কেন্দ্র ও সিলেটের ২২৫ মেগাওয়াট গ্যাসচালিত কেন্দ্র।

এদিকে সক্ষমতার ২০ হাজার ৭৩৮ শতাংশ উৎপাদন দেখানো হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মাঝিপাড়া সোলার পার্ক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। আট মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে গত বছর ২৮ আগস্ট ১৪ দশমিক ১৩ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখানো হয়েছে। যদিও কেন্দ্রটিতে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ইউনিট উৎপাদন সম্ভব। সব মিলিয়ে গত অর্থবছর সক্ষমতার চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি উৎপাদন দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে তারিখ অনুযায়ী উৎপাদনের বেশি গ্যাস সরবরাহের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সাত দিন উৎপাদন ও সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণের পার্থক্য ছিল ১০০ এমএমএসসিএফের বেশি। সবচেয়ে বেশি পার্থক্য ছিল গত ৩ এপ্রিল। ওইদিন উৎপাদনের চেয়ে ১৯৭ এমএমএসসিএফ বেশি গ্যাস সরবরাহ দেখানো হয়েছে। এছাড়া গত বছর ২ আগস্ট ১৯৫ দশমিক ৯০, চলতি বছর ৯ মার্চ ১৩৮ দশমিক ৬০, ২১ মার্চ ১০২ দশমিক ৬০, ১ এপ্রিল ১০৩ দশমিক ৮০, ৪ এপ্রিল ১২৮ দশমিক ৪০ এবং ২৬ জুন ১২৬ দশমিক ৪০ এমএমএসসিএফ বেশি গ্যাস সরবরাহ দেখানো হয়েছে।

এর বাইরে জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রির মধ্যেও পরিমাণগত পার্থক্য রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।