সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম : গত পাঁচ বছরে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ফলে বিপিসির আর্থিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সর্বোপরি সুশাসন নিশ্চিত নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় সরকারের উচ্চপর্যায়েও। অভিযোগ রয়েছে, জ্বালানি তেল কেনাবেচা, পরিবহন ও জাহাজ ভাড়ায় অনিয়ম জিইয়ে রাখতেই দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির অডিট বিভাগকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
বিপিসির সূত্রমতে, ২০১০-১১ অর্থবছরের পর আর কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি। ২০১১-১২, ২০১২-২০১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ পর্যন্ত এ পাঁচ অর্থবছরের কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেনি। এছাড়া ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর ২০০৯-১০ পর্যন্ত ধারাবাহিক কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। অর্থাৎ ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এ তিন বছরের কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি হয়নি। পরে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের সঙ্গে ওই তিন বছরের হিসাব সংযোজিত করা হয়। এদিকে ২০১৪ সালের জুন থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে শুরু করার পর পুরো সময়ই জ্বালানি তেলে লাভ করেছে বিপিসি।
বিপিসি এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রিতে তারা লাভ করেছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করে সাত হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি তেলের বর্তমান দামে বিপিসি চলতি অর্থবছরে মুনাফা করবে সাত হাজার কোটি টাকা। খোদ বিপিসির হিসাবই বলছে, ৬৫ টাকা প্রতি লিটার ডিজেল এবং কেরোসিন বিক্রি করে বিপিসি সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়ার পরও ১৩ থেকে ১৪ টাকা লাভ করছে। আবার প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকায় বিক্রি করে একই পরিমাণ লাভ হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার তেলের দাম কমানোর ফলে বর্তমানে ফার্নেস অয়েলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লাভ হচ্ছে না। অন্যদিকে পেট্রল ৮৬ টাকা আর অকটেন ৮৯ টাকায় বিক্রি করে লাভ করছে ২৬ থেকে ২৭ টাকা। সংগত কারণেই বিপুল এ মুনাফার সঠিক হিসাব রাখা জরুরি বলে মনে করছে সরকার। বেসরকারি পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে এক হাজার কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলেই একাধিক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসহ শক্তিশালী হিসাব বিভাগ থাকে সেখানে। কিন্তু ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও তা অনুপস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি)। দুর্বল অডিট বিভাগ ও অস্বচ্ছ আয়-ব্যয়ের মধ্য দিয়েই চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রসঙ্গে বিপিসি গত পরিচালক (অর্থ) শঙ্কর প্রসাদ দেব শেয়ার বিজকে বলেন, চার বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি। সব একসঙ্গে তৈরির কাজ চলছে, যা দুই মাসের মধ্যে প্রকাশিত হবে।
আর্থিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সর্বোপরি সুশাসন নিশ্চিত করতে বিপিসিতে একটি অডিট বিভাগ থাকলেও তা অনেকটাই নামসর্বস্ব। বর্তমান এ বিভাগে কোনো কর্মী নেই। বিভাগের দায়িত্বে আছেন একজন মহাব্যবস্থাপক। তবে তিনি এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে করপোরেশনের সচিবের সঙ্গে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দেন। বিপিসির সচিব মো. নুরুল আমিন বলেন, বিপিসি অনেক জনবল সংকট আছে। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসানের আর্থিক বিবরণীও তৈরি করে না এ বিভাগ। বাইরের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান (সিএ ফার্ম) দিয়ে বছর শেষে এটি তৈরি করা হয়। অর্থবছর শেষে বহিঃনিরীক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অডিট করার কথা থাকলেও গত চার বছরেও তা করা হয়নি।
বর্তমানে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোয় এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) ও ওরাকলসহ উন্নত মানের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিপিসি ব্যবহার করছে এখনও টালি সফটওয়্যার। ফলে অনেকটা দায়সারাভাবেই চলছে আয়-ব্যয় ও লাভ-লোকসানের হিসাব। সহযোগী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল, ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যে বিল, ভাউচার ও হিসাব দিচ্ছে, তা-ই চূড়ান্ত করছে বিপিসি। অভিযোগ রয়েছে, জ্বালানি তেল কেনাবেচা, পরিবহন ও জাহাজ ভাড়ায় অনিয়ম জিইয়ে রাখতেই দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির অডিট বিভাগকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। এজন্য এ বিভাগে কাজের পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় জনবল সৃষ্টি করা হয়নি।
বিপিসির অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, অডিট বিভাগে একজন মহাব্যবস্থাপক, একজন উপমহাব্যবস্থাপক, একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক, একজন ব্যবস্থাপক, একজন উপব্যবস্থাপক, একজন সহকারী ব্যবস্থাপক ও একজন জুনিয়র কর্মকর্তাসহ ১০ জন জনবল থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে একজন মহাব্যবস্থাপক ও একজন অফিস সহকারী ছাড়া কেউ নেই। অপারেশন বিভাগে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সেখানকার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অডিট বিভাগে সব সময় জনবল ঘাটতি থাকে। এখন তা আরও তীব্র। নিয়মরক্ষার জন্য কিছু নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু এসবই লোকদেখানো।
জনবলশূন্য অডিট বিভাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিপিসির সচিব মো. নুরুল আমিন বলেন, শুধু অডিট বিভাগ সম্পর্কে কেন জানতে চান। বিপিসির সব বিভাগে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে অডিট বিভাগেও ঘাটতি আছে। এ বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারছি না। আপনার প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে দেন। চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে উত্তর দেওয়া হবে।
এদিকে বিপিসির হিসাব ও অডিট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়, কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয় ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফ বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির অডিট করানোর জন্য সরকারকে চাপ দিলেও তা কাজে আসেনি। অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার তাগিদ দিলেও তাতে কাজ হয়নি। আগের নিয়মেই চলছে বিপিসি। প্রয়োজনীয় জনবল, কাজের পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া বিপিসির মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ ভাগের এক ভাগ জনবল দিয়ে চলছে বিপিসি।
২০১৩ সালে সিএজি কার্যালয় পরিচালিত বিপিসির ইফিশিয়েন্সি অডিট প্রতিবেদনেও প্রতিষ্ঠানটির অডিট বিভাগ নিয়ে নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ না থাকায় স্বচ্ছ নিরীক্ষা ছাড়াই সব আয় ও ব্যয়ের বিল পাস হচ্ছে। এ কারণে এসব কোম্পানির সঙ্গে বিপিসির হিসাবে অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত গরমিল রয়েছে। শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যের হিসাবে চারটি কোম্পানির সঙ্গে বিপিসির হিসাবে গরমিল হাজার কোটি টাকার ওপরে। ফলে বিপিসির সব ধরনের লেনদেন ও হিসাব-নিকাশে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি থাকছে না।