রহমত রহমান: দেশের মোট রাজস্বের ৮৭ শতাংশ আদায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যার মধ্যে পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্য খাত থেকে আদায় হয় প্রায় ১০ শতাংশ রাজস্ব। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে এই রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগে বকেয়া রাজস্ব দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে বেশিরভাগ রাজস্ব বিতর্কিত। এর মধ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া আয়কর প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ও শুল্ককর হিসেবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বকেয়া দাঁড়িয়েছে।
এসআরও শর্ত প্রতিপালন, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ, গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ না করা, গ্রাহক থেকে ভ্যাট আদায় করে পরিশোধ না করা, ভতুর্কি মূল্যের ওপর ভ্যাট পরিশোধ না করা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে জেট ফুয়েল সরবরাহ রপ্তানি হিসেবে গণ্য না করা, আয়কর অধ্যাদেশের ৮২সি ধারা বিতর্কসহ মামলা জটিলতায় এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দীর্ঘদিন ধরে আদায় হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠান ও তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত এই রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেয় এনবিআর।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এনবিআর সম্মেলন কক্ষে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে এনবিআর সদস্য, পেট্রোবাংলা ও বিপিসির চেয়ারম্যান, বিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জটিলতা নিরসন করে দ্রুত এসব বকেয়া রাজস্ব আদায়ে সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়, যার ফলে বিদায়ী অর্থবছরের জুন মাসে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আদায় হয়েছে।
সভায় পেট্রোবাংলার বকেয়া তুলে ধরেন এনবিআর সদস্য (কাস্টমস: নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) জাকিয়া সুলতানা। দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাট ও চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের পাওনা সবচেয়ে বেশি। জাকিয়া সুলতানা বলেন, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে এলটিইউ’র মোট পাওনা ২১ হাজার ৮০১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার সাত কোটি আট লাখ টাকা। রেয়াত গ্রহণের শর্ত পালন না করায় পেট্রোবাংলার কাছে এই বিতর্কিত পাওনা সৃষ্টি হয়। পেট্রোবাংলা অর্থ বিভাগ থেকে বাজেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে এই বকেয়া পরিশোধ করা হবে বলে এলটিইউকে এরই মধ্যে জানানো হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ হতে নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি করা এলএনজি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ এবং সুর্দিনিষ্ট কর আরোপিত পণ্যে রেয়াত গ্রহণের সুযোগ না থাকায় দুই হাজার ১৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকা ভ্যাট পাওনা। অর্থ বিভাগ থেকে বাজেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরিশোধ করা হবে বলে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে এরই মধ্যে জানানো হয়েছিল।
জাকিয়া সুলতানা বলেন, ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর অপরিশোধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে পাওনা দাঁড়ায় এক হাজার ৮২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা হাইকোর্টে রিট করলে আদালত এনবিআরের পক্ষে রায় দেন। পরে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সভায় বুক এডকাস্টমেন্টের মাধ্যমে এই রাজস্ব পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু এখনও পরিশোধ করা হয়নি। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রাহকের কাছ থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে ১৫ হাজার ৬৯৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আদায় করা হলেও তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। এছাড়া ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বিধিবহির্ভূতভাবে সমন্বয় করা এক হাজার ৭৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা কর বাতিল করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই দুটি খাতে পাওনা হিসেবে ১৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ২৩ লাখ বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু এখনও পরিশোধ করা হয়নি।
এলটিইউয়ের বকেয়া ২১ হাজার ৮০১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার পুরোটাই অবিতর্কিত। এক্ষেত্রে রেয়াত গ্রহণের ফলে বকেয়া সৃষ্টির বিষয়ে পেট্রোবাংলা রেজিস্টার সংরক্ষণ, এন্ট্রি না করা এবং রিটার্ন দাখিল না করার বিষয়ে সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে রিটার্ন দাখিল ও রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। মূসক বিধিবিধান পরিপালন ও সক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
আমদানি করা এলএনজি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহের বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবিএম আবদুল ফাত্তাহ বলেন, গ্যাসের মূল্য বিআরসি নির্ধারণ করে দেয়। মূল্য নির্ধারণের সময় ভ্যাটের বিষয়টি বিআরসি হিসাবে আনেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আগে পাওনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এক্ষেত্রে রেয়াত প্রাপ্য নয় বলে বোর্ডের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, সেহেতু এই পাওনা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই এবং তা আদায়যোগ্য। গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের ওপর অপরিশোধিত মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পাওনা বাবদ এক হাজার ৮২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং গ্রাহকের কাছ থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ১৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ২৩ লাখ টাকার বিষয়ে কোনো বিতর্ক না থাকায় এর আগে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই বকেয়া পরিশোধে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে অর্থ বিভাগের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় সভার আয়োজন করতে বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
বিপিসির কাছে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের দুই হাজার ৪১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা পাওনার বিষয়ে জাকিয়া সুলতানা বলেন, বিপিসির বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের কাছে ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত আমদানি করা ফার্নেস অয়েল স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ বাবদ ভ্যাট বকেয়া ১৮১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং অব্যবহƒত পণ্যের বিপরীতে অতিরিক্ত ১৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা রেয়াত নেয়া হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে একইভাবে যমুনা অয়েল কোম্পানির কাছে ভ্যাট বকেয়া ১৭৫ কোটি সাত লাখ টাকা এবং অতিরিক্ত রেয়াত নেয়া হয় ১১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। স্থানীয় পর্যায় থেকে নেয়া পণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট বকেয়া ছয় কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভ্যাট বকেয়া ২০১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে জেট ফুয়েল সরবরাহ রপ্তানি মর্মে গণ্য না হওয়ায় শুল্ক বকেয়া এক হাজার ৪৭৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ও স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে ভ্যাট ২৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ভ্যাট বকেয়া ১০৬ কোটি ৬০ লাখ, ১৭ কোটি ২৪ লাখ, রেয়াত এক কোটি ১৫ লাখ টাকা, এক কোটি ৬৭ লাখ টাকা ও উৎসে মূসক সাত কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের কাছে আরও বকেয়া রয়েছে ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
সভায় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর ছাইফুল্লাহ-আল-খালেদ, যমুনা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন আনচারী ও পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, বিপিসি সিদ্ধান্ত দিলে এই অর্থ পরিশোধ করা হবে। পরে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বকেয়া পরিশোধে সম্মতি জানান। তবে পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে জেট ফুয়েল সরবরাহ রপ্তানি হিসেবে গণ্য না করে এ বাবদ ভ্যাট অফিস এক হাজার ৪৭৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা দাবি করেছে। দেশের কয়েকটি এয়ারলাইনস ও বাংলাদেশ বিমানের ক্ষেত্রে ডলারে পেমেন্ট নেয়া হয় না। বিষয়টি সমাধান করতে চিঠি ইস্যু করার বিষয়ে বললে এনবিআর চেয়ারম্যান দ্রুত চিঠি দিতে বলেন।
পেট্রোবাংলা ও বিপিসির কাছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বকেয়া দুই হাজার ৯৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরীয়া বলেন, পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া ৮৪৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা শুল্ককর বকেয়া। সামিট এলএনজি টার্মিনালের বকেয়া ৬০৩ কোটি ৬৮ লাখ এবং এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে ৪৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বকেয়া। বিপিসির বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইস্টার্ন রিফাইনারি ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিকের কাছে বকেয়া ১৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সভায় পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। আর সামিট এলএনজির বকেয়া পরিশোধে জিও হয়েছে বলে জানান গোলাম কিবরীয়া। আর বিপিসির বকেয়া আদায়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান।
অপরদিকে সভায় সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) হাফিজ মোর্শেদ জানান, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে আয়কর বকেয়া ১১ হাজার ৬৬১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যার মধ্যে বিতর্কিত বকেয়ার পরিমাণ ১০ হাজার ৮০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বাকি ৮৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সভায় সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বকেয়া পাওনা ছাড়াও বছরে চার কিস্তিতে অগ্রিম কর আদায় করা হয়। অগ্রিম কর আদায়ে ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি ও কর কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
কর অঞ্চল-৩, চট্টগ্রাম-এর কমিশনার জানান, বিপিসির কাছে ২০১১-১২ থেকে ২০১৮-১৯, অর্থাৎ সাত করবর্ষে বকেয়া করের পরিমাণ ছয় হাজার ৯৭৫ কোটি সাত লাখ টাকা। মামলার মাধ্যমে দাবি সৃষ্টি করা হলে বিপিসি হাইকোর্টে রিট করে। মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে নিয়মিত কর দিচ্ছে বিপিসি। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে কর পরিশোধ করতে বিপিসির চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। হাফিজ মোর্শেদ জানান, পেট্রোবাংলার আওতাধীন বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বকেয়া করের পরিমাণ চার হাজার ৬৮৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যার মধ্যে বিতর্কিত বকেয়া তিন হাজার ৮৩১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং অবিতর্কিত বকেয়া ৮৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অবিতর্কিত বকেয়া দ্রুত আদায় ও বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।