Print Date & Time : 5 August 2025 Tuesday 12:48 am

বিভিন্ন ইস্যুতে স্পষ্টতা নেই, অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা

মো. আসাদুজ্জামান নূর: পতন যেন থামছেই না পুঁজিবাজারে। চলতি সপ্তাহে টানা দুই দিন ও আট কার্যদিবসের সাত দিনই নি¤œমুখী ছিল দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এ আট দিনে সূচক কমেছে ৩১২ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট। এ পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। ফলে লেনদেনও গতি পাচ্ছে না।

ধারাবাহিক এ পতনের কারণ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বিভিন্ন ইস্যুতে কোনো পক্ষই স্পষ্ট করে কিছুই বলছে না। আলোচনা যা হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যেই থাকছে। বলতে গেলে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা বিনিয়োগকারীদের। এ অবস্থায় বিনিয়োগ না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন তারা।

তবে বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণের বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যেসব ইস্যুতে বিনিয়োগকারীরা আশাহত সেগুলো নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই। এ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত এলেই যে আস্থা ফিরে আসবে এমন নয়। উড়ো খবরে গাঁ না ভাসিয়ে বুঝে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

গতকাল সোমবার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ১০০ কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২৪১টির। অন্যদিকে দর ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ৩৩ কোম্পানি। এর প্রভাবে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স হ্রাস পেয়েছে ৪৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট। দিনশেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৭৩৬ পয়েন্টে। এছাড়া অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস ১০ পয়েন্ট ও ডিএস৩০ সূচক হ্রাস পেয়েছে ১৯ পয়েন্ট। আগের কার্যদিবস রোববার প্রধান সূচক হ্রাস পায় ৮৪ দশমিক ৯৮ পয়েন্ট।

এদিকে বিনিয়োগবিমুখ হওয়ায় লেনদেনে ভাটা পড়েছে। আড়াই মাস আগে ডিএসই’তে এক ঘণ্টায় যে লেনদেন হতো, এখন সাড়ে চার ঘণ্টাতেও তা দেখা যাচ্ছে না। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিনই লেনদেন ছিল দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৪ অক্টোবর হাতবদল হয় দুই হাজার ৭৫৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। সেই লেনদেন এখন নেমেছে সাত থেকে ৮০০ কোটি টাকার ঘরে। গত পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে এক দিনই কেবল এক হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল।

১৩ ডিসেম্বর তা গত আট মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৭০০ কোটির নিচে নেমে যায়। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৮০৭ কোটি ১৬ লাখ টাকার। আগের কার্যদিবসে এটি ছিল ৭৮৬ কোটি ২১ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারে ব্যাংকে বিনিয়োগের যে সীমা বা এক্সপোজার লিমিট, সেটি শেয়ারের বাজারমূল্য নাকি ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ হবে, বন্ডে বিনিয়োগ এ সীমার বাইরে থাকবে কি নাÑএ দুটি বিষয় নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ মতভিন্নতায় শুরু হয় পুঁজিবাজারের ওঠানামা। এর সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র বৈঠকের পরে বিএসইসি জানায়, ওইসব বিষয়ে তারা নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এর বিপরীতমুখী বিবৃতি দেয়।

এরপর গত ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিনিয়োগকারীরা ধরে নিয়েছিলেন, বৈঠক শেষে ওই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি। এরপর ধারাবাহিকভাবে পতন দেখা গেছে বাজারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সেই বৈঠকটি এক্সপোজার লিমিট নিয়ে নয় বলে জানান বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে বছর দুয়েক আগে অর্থমন্ত্রীর দেয়া কিছু নির্দেশনার সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়।

সে বৈঠকে জানানো হয়, এক্সপোজার লিমিট ও বন্ডে বিনিয়োগের বিষয়ে ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে আরও একটি বৈঠক হবে। সে বৈঠকের পর দৃশ্যমান একটি ঘোষণা আসবে। সে বৈঠকের আলোচনা আশাবাদী হওয়ার মতো হলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়ে গেছে। সেইসঙ্গে ডিসেম্বর ক্লোজিংয়ের কারণে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কিছু মিউচুয়াল ফান্ড এবং বহুজাতিক কোম্পানির প্রফিট টেকিংয়ের কারণে বিক্রয় চাপ এবং নতুন করে শেয়ার না কেনার কারণে লেনদেনও গতি পাচ্ছে না।

এ বিষয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপক শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন বলেন, বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে রয়েছেন, যার কারণে বিনিয়োগ কমেছে। চলমান ইস্যু নিয়ে এখনও কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা নেই। কোনো পক্ষই কোনো দায় নিতে চায় না। অর্থাৎ কোনো পক্ষই বলছে না যে, এ সমস্যা সমাধানের জন্য এ নির্দিষ্ট পদক্ষেপটি নেয়া হলো। যা ঘটছে তাদের মধ্যেই থাকছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা অন্ধকারে রয়েছেন, যা মার্কেটে প্রভাব ফেলছে।

তবে চলমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কিছু নেই বলে জানান পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, এক্সপোজার লিমিট নিয়ে কোনো ঘোষণা না আসাটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য ভালো নয়। তারা জুয়াখেলার পেছনে ছোটে। জাঙ্ক শেয়ার কেনে। সেগুলো থেকেও লাভবান হওয়া যায়, তবে যখন বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখন। কিন্তু বাজার পতনের সময় লোকসানে পড়তে হয়। বুঝে-শুনে ভালো শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে এ অবস্থাতেও কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে নির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না আসায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করেন মাসুম জামান নামের এক বিনিয়োগকারী। তিনি বলেন, মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেন না। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, যেমন মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকাররাই বাজারের ওঠানামায় প্রভাব বিস্তার করে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট-বিষয়ক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে বাড়ছে-কমছে। ফলে সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত স্টেকহোল্ডাররা স্থির বিনিয়োগে যাবে না, তেমনি বাজারও স্থির হবে না। এতে লোকসানে পড়বেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

বিনিয়োগকারীদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে সবাই মুনাফা করতেই আসে। বাংলাদেশের মার্চেন্ট ব্যাংক বা স্টেকহোল্ডাররা ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের মতোই আচরণ করে। ফলে তারাও মুনাফা টেকিং করবে, এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য রাখতে হবে বলে জানান তিনি।