রাহমান আরিফ : বিমা খাতে স্বচ্ছতা আনতে বিদ্যমান বিমা আইনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, কোম্পানি পরিচালনায় পারিবারিক অধিপত্য কমানো ও জাল-জালিয়াতি ঠেকাতে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতেই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বীউনিক)। ১৫ বছরের পুরোনো আইনকে সময়োপযোগী ও অন্য আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতেই বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এবার ৩৯৯টি জায়গায় সংশোধন আনতে চায় বীউনিক। এরই মধ্যে এ বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত চেয়েছে সংস্থাটি। ২০১০ সালে প্রণীত বিমা আইন সময়োপযোগী হলে বিমায় শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালে প্রণীত বিমা আইনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৯৯টি সংশোধনী আনছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিমা কোম্পানিতে পারিবারিক আধিপত্য কমানো, বিমা এজেন্ট কমিশন কমিয়ে আনা, সম্পদ বন্ধ রেখে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করা, তদন্তের প্রয়োজনে কোম্পানিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তকারীদের তল্লাশি-জব্দের ক্ষমতা দেয়া, জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি, বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ও সম্পদ বিক্রি করে দায় পরিশোধ এবং আইন লঙ্ঘন করলে প্রয়োজনে কোম্পানির পরিচালনা ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। এসব পরিবর্তনের বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীউনিক। আগামী ৮ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়ে নির্ধারিত ইমেইলে মতামত দেয়া যাবে।
তথ্যমতে, বিমা সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়ম, সরকারি শেয়ারে নিয়ম মেনে বিনিয়োগ করা করা, নির্ধারিত সীমার বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয়, প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন ও বিমা দাবি পরিশোধ ইস্যুতে বিতর্কের পর বিগত সরকারের সময়ে অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি বীউনিক। আইনি সীমাবদ্ধতা বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। তাই আইন সংশোধনের সময় বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। কোনো বিমা কোম্পানি গ্রাহকের স্বার্থ পরিপন্থি কোনো কাজ করলে সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এমন ক্ষেত্রে কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে নতুন পর্ষদ গঠন করতে পারবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এদিকে বিমা কোম্পানিতে পারিবারিক আধিপত্য স্বচ্ছতা-জবাবদিহির পথে বড় অন্তরায়। তাই জীবন বীমা ও সাধারণ বিমা কোম্পানিতে পারিবারিক আধিপত্য কমানো হচ্ছে। আইন সংশোধনের পর কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা পরিবার প্রত্যক্ত বা পরোক্ষভাবে কোনো বিমা কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। সেইসঙ্গে বিমা কোম্পানির পরিচালক, উদ্যোক্তা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার বিষয়টি আইন করে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এমন নির্দেশনা বেশকিছু শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে পারিবারিক আধিপত্য ও অনিয়ম-জালিয়াতি কমবে-বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো এজন্টনির্ভর। যে কারণে এজেন্ট কমিশনের পেছনে কোম্পানিগুলোকে আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হয়। কখনও কখনও কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে এ খাতে বাড়তি অর্থ ব্যয়ের অভিযোগও ওঠে, যা কোম্পানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এ বিষয়টিও আমলে নিয়েছে বীউনিক। বর্তমানে জীবন বিমা এজেন্টরা প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের ওপর কমিশন ৩৫ শতাংশ কমিশন পায়Ñ যা সংশোধনীতে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বছরে এ কমিশন ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।
সংশোধিত আইনে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রেও পেশাগত অভিজ্ঞতার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। আইন কার্যকর হলে বিমা কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর বিমা কোম্পানির পরিচালক হিসেবে টানা ছয় বছরের বেশি কেউ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিমায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষণ-পরিদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তকারী দল বিমা কোম্পানির অফিসে তল্লাশি চালাতে পারে না। প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করার ক্ষমতাও নেই বীউনিক সংশ্লিষ্টদের। তাই বিষয়টিকে আইনি ভিত দেয়া হচ্ছে। সংশোধিত আইনে তদন্ত দলকে তল্লাশি-নথি জব্দের ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে। একইভাবে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধের জন্য কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতাও দেয়া হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীউনিককে।
একইভাবে কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে না পারলে নতুন পলিসি বিক্রি বা প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিধান রাখা হচ্ছে। এ ব্যর্থতার জন্য কোম্পানিকে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও দৈনিক ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে বীউনিক। সেইসঙ্গে অনিয়মের দায়ে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এতে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পথ তৈরি হবে বলে মত দিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ৩৬টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি মিলিয়ে মোট ৮২টি বিমা কোম্পানি ব্যবসা করছে। এর মধ্যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিও রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থার সংকট রয়েছে। যে কারণে গত ১৪ বছরে প্রায় ২৬ লাখ বিমা পলিসি বাতিল হয়েছে। একইভাবে বিমার মেয়াদ শেষে কিছু বিমা কোম্পানির গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে কালক্ষেপণ করছে। ২০২৪ সালে বিমা দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। এ বছরে প্রায় ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে গ্রাহকরা মাত্র ৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা পেয়েছেন। একইভাবে কিছু কোম্পানি রাজনৈতিক প্রভাবের জোরে বিদ্যমান আইন ভেঙে গ্রাহকের অর্থ বিনিয়োগের নামে সরিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সে কারণেই আইন সংশোধনে কাজ করছে বীউনিক।