Print Date & Time : 27 August 2025 Wednesday 9:45 pm

বিমা কোম্পানির মুনাফার অংশ পাচ্ছে না শ্রমিকরা

রাহমান আরিফ : আইনি জটিলতা ও সঠিক দিকনির্দেশনার কারণে বিমা খাতে কোম্পানিগুলোয় কর্মরতদের স্বার্থরক্ষায় ‘ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড’ গঠন করা হচ্ছে না। এতে একদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানির মুনাফার অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কর্মরতরা। ‘শ্রমঘন নয়, কিংবা দৃশ্যত শ্রমিক নেই’ দাবি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রম আইনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি চাইছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসা করা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা বা স্থায়ী সম্পদ দুই কোটি টাকার বেশি হলে সেই কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য মুনাফায় অংশগ্রহণ তহবিল (ডব্লিউপিপিএফ) থাকতে হবে। প্রতি বছর কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফার পাঁচ শতাংশ সেই তহবিলে জমা হবে। তহবিলের অর্থের ৮০ শতাংশ কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিকরা পাবেন। আর ১০ শতাংশ অর্থ কোম্পানির শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে যোগ হবে। ডব্লিউপিপিএফের বাকি ১০ শতাংশ অর্থ সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় পরিচালিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দিতে হবে।

আইনে থাকলেও দেশের ৩৫ জীবন বিমা ও ৪৫টি সাধারণ বিমা কোম্পানি নিজেদের ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান’ বলে দাবি করে শ্রমিকদের মুনাফার অংশ দিচ্ছে না, যদিও এখনও আইনগতভাবে ‘বিমা খাত’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত নয়। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোকে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে উল্লেখ করে ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডব্লিউপিপিএফ তহবিল গঠনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যহতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখনও বিমা খাতের কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

সূত্রগুলো বলছে, বিমা কোম্পানিগুলো নিজেদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করে আসছে বিমা কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনে (বিআইএ)। এ আইন পরিপালন থেকে অব্যাহতির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সঙ্গে আলোচনাও করেছে সংগঠনটি। আলোচনার পর এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও সেই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে ‘সিদ্ধান্ত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে’ বলে উল্লেখ করে ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড গঠন করছে না বেসরকারি ৮০টি সাধারণ ও জীবন বিমা কোম্পানি। যদিও বিদ্যমান আইন পরিপালন না করে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর কথা বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই, যে কারণে বিমা কোম্পানিগুলোর এই আইন লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নিরীক্ষকরা।

বিমা খাতের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে ব্যবসারত বেসরকারি ৮০টি বেসরকারি বিমা কোম্পানিরই শ্রম আইন অনুযায়ী ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড গঠন করার কথা। কারণ কোম্পানিগুলো পরিশোধিত মূলধন আইনে বর্ণিত সীমার ওপরে, যে কারণে কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নিরীক্ষকরা।

সাধারণ বিমা খাতের কোম্পানি মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া আর্থিক বছরের আয়-ব্যয় নিরীক্ষাকালে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে আলাপকালে মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব সাইফুল কবির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিমা কোম্পানিও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই নির্দেশনা আমলে নিয়েই আমরা ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড গঠন করিনি। এ বিষয়ে আইডিআএ’র পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। উত্তর কী এসেছে, সেটা খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। এখন বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হলে আমরা সেটা মেনে চলব।’

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমা কোম্পানিগুলো নিজেদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে শ্রম আইন ভঙ্গ করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে সেই চিঠি ঝুলে থাকার দোহাই দিয়ে কোম্পানিগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে। রহস্যজনক কারণে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কারণে বিমা কোম্পানিগুলোতে কর্মরত প্রায় ১০ লাখ কর্মী ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেইসঙ্গে সরকারি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনও মুনাফার অংশ পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বিমা কোম্পানির ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। যেহেতু বিমা কোম্পানিগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একই মন্ত্রণালয়ের অধীন, তাই ব্যাংকের মতো বিমা কোম্পানিগুলোও শ্রম আইনের বাধ্যবাধকতার বাইরে থাকার কথা। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই প্রতি বছর নিরীক্ষার সময় এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। আমরা আবারও বিয়ষটি নিয়ে আইডিআরএ’র সঙ্গে আলোচনা করব। আশা করছি, সব দিক বিবেচনায় ডব্লিউপিপিএফ ইস্যুর নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা বিদ্যমান আইন মেনেই বিষয়টি সুরাহা করতে চাই।