বিয়ে নিয়ে প্রতারণা ও নতুন অপরাধের গল্প

মোহাম্মদ অংকন: ছেলে উচ্চশিক্ষিত। দেশের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, ডাক্তারি পড়েছে। ভালো বিষয় নিয়ে পড়েছে। তবে এখনও চাকরি পায়নি। চেষ্টা করছে। আশা করি পেয়ে যাবে। মেধা আছে। বিসিএস ক্যাডারও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে বলে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ছেলেপক্ষ থেকে গ্রামগঞ্জে এমন সংবাদ মানুষের কানে কানে রটিয়ে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে ধনী পরিবারের মেয়েকে। ধনী পরিবারগুলোও দেখছে, নিজেদের অর্থবিত্তের তেমন দরকার নেই; যা আছে, তা মেয়েকে দিলে সারাজীবন কিছু না কিছু করে খেতেই পারবে। কিন্তু দরকার শিক্ষিত মেয়েজামাই। শিক্ষিত মেয়েজামাইয়ের সন্ধান করতে গিয়ে মিলছে শিক্ষিত বেকার ছেলে। যেহেতু ছেলে উচ্চশিক্ষিত। ছেলে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, ডাক্তারি পড়েছে। ভালো বিষয় নিয়ে পড়েছে। চাকরি তো পাবেই। এমন ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি কীসের!

ছেলেপক্ষের অতিগল্পে মন মজে প্রলুব্ধ হয়ে কিংবা গভীরভাবে খোঁজ-খবর না রেখেই মেয়েপক্ষ মেয়ে তুলে দিচ্ছে শিক্ষিত বেকারের হাতে। প্রশ্ন হতে পারে, শিক্ষিত বেকাররা কি বিয়ে করবে না? অবশ্যই করবে। তবে তাদের অধিকাংশই আমাদের সমাজে যে পন্থায় এগোচ্ছে, যেভাবে মেয়েপক্ষকে বিয়েতে প্রলুব্ধ করছে, তা রীতিমতো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা এবং এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার থেকে সমাজে, যার ফলে বিয়েবিচ্ছেদ, নারী নির্যাতন, নারীদের আত্মহত্যাসহ নানা সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। কীভাবে বাড়ছে, তারও ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

বিয়ের প্রাথমিক দিনগুলোয় ছেলেপক্ষ যখন জানিয়েছিল, তার ছেলে উচ্চশিক্ষিত। দেশের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, ডাক্তারি পড়েছে। ভালো বিষয় নিয়ে পড়েছে। চাকরি পাবেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এসব প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হচ্ছে। ছেলে কতটুকু শিক্ষিত মেয়েপক্ষ যাচাই-বাছাই করতে না পারলেও সমাজের অন্য যারা শিক্ষিত ও সচেতন আছেন, তারা ছেলের ডিগ্রির মাপকাঠি দেখেই অনুমান করতে পারছেন, কেমন শিক্ষিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম শুনেই বুঝতে পারছেন কেমন নামিদামি। ভুঁইফোঁড় ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারিসহ নানা সার্টিফিকেটের বাহার সাজিয়ে এলাকায় নাম ছড়িয়ে ধনী পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করার বিষয়ে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে এবং কাজও হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, একটা সময় অতিবাচ্য করা ছেলেটা চাকরি পাচ্ছে না। শ্বশুরবাড়িতে নিজের ডিগ্রির প্রভাব দেখিয়েই মোটামুটি জমিয়ে ফেলেছে। চাকরি যখন হচ্ছে না, শ্বশুর যখন ধনী, তাহলে স্ত্রীকে বলে কিছু যৌতুক এনে ব্যবসায় নামা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে এই যৌতুকের বিষয় নিয়ে বিয়েবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। যে মেয়েপক্ষ ভেবেছিল, মেয়েজামাই তার চাকরি করবে, শহরে যাবে মেয়েকে নিয়ে, সে কিনা এখন গ্রামে বসে ব্যবসা করতে যৌতুক চাচ্ছে। তাহলে কেন মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দিলাম? আমার মেয়ের তো শখ পূরণ হলো না। যে ছেলে এত নামিদামি সার্টিফিকেটধারী, সেই কিনা চাকরি পেল না, সে কি ব্যবসা করতে পারবে? আমি যৌতুকের টাকা দেয়া শুরু করে নিজের ও মেয়ের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছি কিনা?

গ্রামগঞ্জের মানুষ এখনও এতটা শিক্ষিত-সচেতন হয়ে উঠতে পারেনি, যারা কিনা কারও সার্টিফিকেট দেখে যাচাই-বাছাই করতে পারবে যে, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। গ্রামগঞ্জের মানুষ সাধারণ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীকেও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জেনে থাকে। যারা এই ডিগ্রি অর্জন করে, তারাও নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার দাবি করে সমাজে বলে বেড়ায়। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এসব অতিবাচ্য ডিগ্রির গল্প শুনে মেয়েপক্ষ মেয়েকে সোপর্দ করে, বিপরীতে প্রতারিত হয়। আসলে আমাদের স্বভাবটাই এমনÑনিজে যতটুকু না, তার চেয়ে বাড়িয়ে বলা। এই বাড়িয়ে বলাটা কতটুকু ভয়ংকর, তা হয়তো অনেকেই উপলব্ধি করতে পারি না আমরা।

বেকার হোক, শিক্ষিত হোক, আর কম নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক, কিংবা বেশি নামিদামি হোক, যা আছে সেটুকু প্রকাশ করার মধ্যদিয়েই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু আর্থিক সুবিধা পেতে, ভালো বংশের মেয়ে পেতে, সুন্দরী মেয়ে পেতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করে পরিণামে সেই সম্পর্ককে ভেঙে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির মানেটা কী? এটা কি নতুন অপরাধ নয়?

বিয়েশাদি মানুষের মৌলিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র বিষয়। কিছু উচ্চাভিলাষী মানুষ নিজেদের সম্পর্কে অত্যুক্তির মাধ্যমে গ্রামের অন্য মানুষকে ঠকাচ্ছে। মেয়েপক্ষের যখন উপলব্ধির জায়গা পরিষ্কার হচ্ছে, যখন বুঝতে পারছে, ছেলেপক্ষের মিথ্যা ও বানোয়াট কথার ফাঁদে পড়ে মেয়েকে তুলে দিয়েছি, তখন এ নিয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি বাবা-মা চান, মেয়ে তার স্বামীর ঘরে সুখে থাকুক, যে কারণেই চেষ্টা করা হয়েছে মেয়েকে শিক্ষিত-সচেতন কারও হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পরিণামে যে প্রতারণার শিকার হয়েছে, শিক্ষিতের গালগল্প শুনিয়ে সম্পদের দিকে নজর দিয়ে মেয়েকে বিয়ে করেছে, যখন কাক্সিক্ষত সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারছে না, তখন মেয়েকে নির্যাতন করছে, তখন মেয়েপক্ষ বুঝতে পারছে যে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল আসলে। মানুষের মুখে উচ্চশিক্ষার গল্প শুনে যে বিরাট ভুল হয়ে গেছে, তা সংশোধনের উপায় কী!

সময়কাল এখন বেশি সুবিধার নয়। মানুষ মানুষকে কীভাবে প্রতারিত করবে, কীভাবে বিপদে ফেলবে, কীভাবে নিজে যা না, তা প্রচার করে উদ্দেশ্য হাসিল করবেÑএসব নিয়েই ব্যস্ত বেশি। বেকার হলেই যে সত্যটা বলে বিয়ে করা যাবে না, নিজের অর্জিত শিক্ষার প্রকৃত মাপকাঠি প্রকাশ করলেই যে বিয়ে হবে না, তা তো না। সত্য প্রকাশে মানুষের ভয় বেশি, মিথ্যা বলতে মুখে আটকায় না। মানুষকে প্রলুব্ধ করতে পেরে কিছু পৈশাচিক আনন্দ পায় বটে। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মানুষ কী না করতে পারে! আমাদের সমাজে মেয়েপক্ষেরও দোষ আছে। কেন তারা যাচাই-বাছাই না করেই মেয়েকে তুলে দেয়? তারা কি দেশের খোঁজ-খবর রাখতে পারে না? পাত্রপক্ষ যা বলছে, তা তো যাচাই-বাছাই করা কঠিন কিছু নয়। যে ছেলে ডিপ্লোমা পাস করেই নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার দাবি করছে, কিংবা ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে জানাচ্ছে দুই লাখ মাসে আয়Ñএসব যাচাই-বাছাই করা তো মামুলি ব্যাপার। কিন্তু না, তা করা হচ্ছে না। মানুষের গালগল্পে বিশ্বাসী হয়ে প্রতারিত হচ্ছে। বিয়ের পর যখন দেখছে এ সবই ছিল অত্যুক্তি, তখনই বিপাকে পড়ছে। মেয়েকে ডিভোর্স করাতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

ইদানীং বিয়ে নিয়ে নানা প্রতারণামূলক ঘটনা ঘটছে আমাদের সমাজে। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে এসবের ভয়ংকর চিত্রের দেখা মেলে। এমন সব লোমহর্ষক ঘটনা চোখের সামনে আসে, যা দেখে শরীর শিউরে ওঠে যে, বিয়ে নিয়েও এমন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ! সম্পর্কের শুরুতেই যদি প্রতারণার আশ্রয় নিতে হয়, পরিণামে এই সম্পর্ক কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, তা কল্পনারও বাইরে। অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করতে বিয়ের নাটক সাজিয়ে কেউ কেউ স্ত্রীকে হত্যা করে লুটে নিয়ে নিচ্ছে শ্বশুরের ধনসম্পদ। কী সাংঘাতিক মানুষের লোভ! এ যেন থ্রিলারকেও হার মানাচ্ছে। তাই সময় এসেছে আমাদের সচেতন হওয়ার। ছেলে কিংবা মেয়ে হোক, বিয়ে দেয়ার আগে ব্যক্তি-পরিবারসম্পর্কিত তথ্যগুলো অবশ্যই যাচাই-বাছাই করতে হবে। অর্থ-সম্পদ অর্জনের আশায় মিথ্যা কথা বলে বিয়ে করা এখন সমাজে নতুন অপরাধ হিসেবে জš§ নিতে শুরু করেছে।

         মুক্ত লেখক, ঢাকা