বিলুপ্তপ্রায় রিকশা পেইন্টিং

মাকসুদা আক্তার : উনিশ শতকের শেষ দিকে পৃথিবীতে রিকশা নামক বাহনটির সূত্রপাত হয় বলে জানা যায়। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৮৬৯ সালে জাপানে রিকশার সূচনা হয়। সিমলার মার্কিন মিশনারি জোনাথন স্কোবি এটি উদ্ভাবন করেন। রিকশা শব্দটিও বাংলায় এসেছে জাপানি শব্দ জিনরিকিশা থেকে, এখানে জিন-মানুষ, রিকি-শক্তি, শা-বাহন। অর্থাৎ এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো মানুষবাহিত বাহন। বিশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রিকশার প্রচলন হয়। প্রথমে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে এবং ১৯৩৮ সালে ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার একজন বাঙালি জমিদার ও ওয়ারী অঞ্চলের একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোক ছয়টি রিকশা কিনে ঢাকায়ও রিকশার প্রচলন করে বলে জানা যায়। ধীরে ধীরে ঢাকা পরিণত হয়ে রিকশার শহর নামে। ত্রিশ বা চল্লিশের দশকে বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটলেও রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে। রিকশা পেইন্টিং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে এ সময় থেকে। 

একটি রিকশা তৈরি থেকে রাস্তায় নামা পর্যন্ত ছয় শ্রেণির পেশাজীবী কাজ করেনÑ হুড মিস্ত্রি, বডি মিস্ত্রি, বাতা কারিগর, ফিটিং মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি এবং পেইন্টার। পেইন্টাররাই রিকশার চারকোনা বোর্ড, পর্দা ও পেছনে বডির গায়ে পাতলা টিনের ওপর বাহারি চিত্র আঁকেন। এঁদের মূলত রিকশা পেইন্টার বলা হয়, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী প্রাণী থেকে শুরু করে নানা বস্তুর বৈচিত্র্যময় প্রকাশ ঘটান নিজের সৃজনশীলতার মাধ্যমে। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিং বা রিকশা চিত্রের বিখ্যাত শিল্পী আলী নূর, দাউদ উস্তাদ, আর কে দাসসহ আরও অনেকে পৈতৃক পেশা ত্যাগ করে রিকশা পেইন্টিং শুরু করেন। তখন এর চাহিদাও ছিল ব্যাপক।

রিকশা পেইন্টিং কে, কোথায়, কবে শুরু করেছিলেন তা সঠিক জানা যায় না। ফলে এটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি চিত্র বলে ধরা হলেও বিভাজন হয়নি রিকশা চিত্র বা পেইন্টিং আসলে কোনো ধরনের চিত্রকর্ম। রিকশার গায়ে বিবিধ রঙে আঁকা এসব চিত্রকে জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিক তার ‘বাংলাদেশি আর্টস অব দ্য রিকশা’ প্রবন্ধে গণমানুষের চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন। অভিজাত শিল্পে রিকশা আর্ট নেই। লোকশিল্পেও এর শেকড় মেলেনি। ফলে সাধারণ মানুষের সখের বাহন এ রিকশার চিত্রকে গণমানুষের চিত্র বলা অযৌক্তিক নয়।

অ্যাক্রিলিক, গ্লাস পেইন্টিং, অ্যানামেল রং ব্যবহার করে রিকশা পেইন্টিং করে থাকেন চিত্রীরা। রিকশা পেইন্টিংয়ে, বিশেষ করে উজ্জ্বল রং নির্বাচনে, সিনেমার ব্যানার চিত্রীদের কাজের প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। রেখার ব্যবহারে লোকায়ত ধারার প্রভাব অধিক দৃষ্টিগোচর হয়। আবার বিভিন্ন ক্যালেন্ডার বা ছাপা ছবিকে মূল হিসেবে ব্যবহার করে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়েও রিকশা পেইন্টাররা চিত্র এঁকে থাকেন।

একটি নতুন রিকশাকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলায় কাজ করে রিকশা পেইন্টাররা। রিকশা চিত্রের মূল লক্ষ্য রিকশাকে মানুষের কাছে সুসজ্জিত ও আকর্ষণীয় করে তোলা। সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী চিত্র এঁকে থাকেন। গত ষাট/সত্তর বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে। ৬০-৭০-এর দশক ছিল রিকশা আর্টের স্বর্ণযুগ। এর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়কে সিনেমার উত্তমকাল বললেও ভুল হবে না। শিল্পীরা তখন রিকশার গায়ে আঁকার উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেসব জনপ্রিয় সিনেমার সাধারণ মানুষের প্রিয় নায়ক নায়িকা যেমনÑ কবরী, ববিতা, জসীম, রাজ্জাক প্রমুখের ছবি, এরপর নব্বই দশকের মান্না, শাবনূর এরাও জায়গা পেয়েছে রিকশা চিত্রে। রিকশাকে কেন্দ্র করে গানও ছিল সেসব সিনেমায়। যেমনÑ‘ও সখিনা গেছস কি না ভুইলা আমারে আমি এহন রিকশা চালাই ঢাকা শহরে’।”

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে আঁকা হয় লড়াইয়ের নানা চিত্র। রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্যও আঁকা হতো রিকশায়। গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য, পেচাজীবী মানুষের ছবি ছিল রিকশা পেইন্টিংয়ের সাধারণ বিষয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পশু, পাখি, ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি তো আছেই।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রিকশায় মানুষের ছবি আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশা পেইন্টাররা মানুষের পরিবর্তে পশুপাখির ছবি আঁকায় অধিক মনোযোগ দেয়া শুরু করে। তখন মানুষের স্থলে নানা প্রাণীকে আঁকা হয়। যেমনÑ রান্না করছে একটি বিড়াল, রাস্তা পার হচ্ছে একটি শিয়াল, বাঘ বা সিংহের মাথায় মুকুট দিয়ে সভায় বসেছে। এছাড়া বিভিন্ন পুরাণ ও ইসলামি ঐতিহ্যের নানা বিষয়ও রিকশা চিত্রে জায়গা করে নেয়। যেমন- মুসলিম ঐতিহ্যের প্রার্থনারত বালক-বালিকা, মুসলিম উপাখ্যানের দুলদুল, বোরাক অথবা আরব্য রজনীর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও দৈত্য, রাজা, রাজকন্যা, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাদায় আটকে যাওয়া গরুর গাড়ির চিত্র ‘সংগ্রাম’ এবং পটুয়া কামরু হাসানের গরুর গাড়িতে ‘নাইওর’ চিত্রগুলো রিকশা পেইন্টিংয়ের অন্যতম বিষয় ছিল। দেশীয় চিত্র হিসেবে রিকশায় জায়গা পেতো শহিদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, ব্রিজ, সংসদ ভবন, মসজিদসহ আরও নানা জিনিস। ভিনদেশি দৃশ্য হিসেবে তাজমহল, হাওড়া ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ ইত্যাদিও দেখা যেত রিকশা চিত্র হিসেবে।

তবে রিকশাচিত্রের বর্তমান অবস্থা এবং রিকশাচিত্রীদের পেশা এখন হুমকিতে। যারা এখনও সক্রিয় হয়ে কাজ করছেন তারা মূলত বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশিদের শখ মেটানো গেলেও তাতে রিকশাচিত্রীদের জীবনের আহামরি কোনো লাভ হচ্ছে না। হাতে আঁকা পেইন্টিংয়ের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বিশেষ রীতির চিত্রকলা আজ হুমকির সম্মুখীন। আবার বিভিন্ন সিডি, বক্স, কাগজ দিয়েও দ্রুত সাজিয়ে নেয়া হচ্ছে রিকশাকে, ফলে পেইন্টিংয়ের আর প্রয়োজন পড়ছে না তাদের। পেশাগত দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে রিকশা পেইন্টাররা। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ রিকশাচিত্রী পেশা পরিবর্তন করেছেন বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর চারুশিল্পের ইতিহাসেও বিশেষ ধরন বা শৈলী হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারার বিলুপ্তি ঘটলে পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য শৈলীর অবসান ঘটবে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি বাংলাদেশে রিকশাচিত্র নিয়ে কিছু কিছু উদ্যোগের খবর জানা যাচ্ছে। এ চিত্র আজ রিকশার গায়ের জায়গা ছেড়ে তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে। ফুলের টব, চেয়ার, টেবিল, কেটলি, টেবিল ল্যাম্প, পর্দা, বুকস্ট্যান্ড, চায়ের কাপসহ যেকোনো জিনিসেই এ নকশা করা যায়। বাদ যাচ্ছে না ঘরের দেয়ালও। অন্দরসজ্জায় হঠাৎ করেই যেন রঙিন নকশা কথা বলে উঠছে। এ নকশা যেখানেই করা হোক না কেন তার নান্দনিকতা উপেক্ষা করা অসম্ভব। এ কদর ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন প্রখ্যাত ডিজাইনার বিবি রাসেল। তার হাত ধরে রিকশা চিত্র এক জনপ্রিয় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কাজ করেছেন সংগীতশিল্পী আনুশেহ্ আনাদিল। তার ফ্যাশন হাউস ‘যাত্রা’র নানা রকম পণ্যের গায়ে রিকশা চিত্র গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। সম্প্রীতি কয়েক মাস আগে টিএসসির আশপাশের নানা জিনিসকে রিকশা পেইন্টিংয়ে সাজিয়ে দেন মিস ইউনিভার্স শিরীন আক্তার শিলা। তার এই কাজ মুগ্ধ করে শিক্ষার্থীসহ রুচিশীল মানুষদের।

এরপরও আশঙ্কা থেকে যায়, দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে যেন তাল মেলাতে পারছে না এই পেইন্টিং। ফলে ঢাকা শহর থেকে রিকশার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে রিকশা পেইন্টিংও। বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য এ চিত্রকলাকে বাঁচিয়ে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়