ইসমাইল আলী: রাজধানীর ১২৬টি রুটের বাসের গন্তব্য মিরপুর। এগুলোর শুরু বা শেষ মিরপুরের কালসী, ১২, ১০, পল্লবী বা বৈকালি হোটেল। আবার মতিঝিলে রয়েছে ১১২টি রুটের বাসের গন্তব্য। মতিঝিল, আরামবাগ, দৈনিক বাংলা, পীরজঙ্গি মাজার, কমলাপুর প্রভৃতি স্থানের নামে ভিন্ন ভিন্ন এসব রুট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গুলিস্তানের ক্ষেত্রেও চিত্র একই। গোলাপ শাহ মাজার, গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ফুলবাড়িয়া প্রভৃতি নামে গুলিস্তানে শেষ হয়েছে ৮৬টি রুট।
একই স্থানে এভাবে অসংখ্য বাসের রুট শুরু বা শেষ হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে তৈরি করছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বাসগুলোর সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারও হয় না। ফলে যাত্রার সময় বিলম্বের পাশাপাশি যাত্রীদের হয়রানিও কম হয় না। যদিও বিশৃঙ্খল এ বাস ব্যবস্থার ওপরই রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন যাতায়াতের (ট্রিপ) প্রায় অর্ধেক নির্ভরশীল। বাস ছাড়া যাতায়াতে গতিও নেই তাদের।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধন করেছে সরকার। এতে উঠে এসেছে বাস ব্যবস্থার ওপর রাজধানীবাসীর নির্ভরশীলতার তথ্য। এছাড়া মেট্রোরেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালু হলেও আগামীতে বাস-মিনিবাসের চাহিদা কমবে বলেই তাতে দেখা যায়।
সংশোধিত এসটিপিতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ঢাকা ও আশপাশে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের বসবাস ছিল। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর দৈনিক ট্রিপের পরিমাণ ছিল প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে বাসে ট্রিপ হয় ৪৭ শতাংশ। আর রিকশায় ট্রিপের পরিমাণ ৩২ শতাংশ। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িতে ৯, সিএনজি অটোরিকশায় ৯ ও মোটরবাইকে ৩ শতাংশ ট্রিপ হয়।
এদিকে রাজধানীতে যানজট কমাতে মেট্রোরেল ও বিআরটি নির্মাণ করা হলেও বাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে না। এতে দেখা যায়, ২০২৫ সালে রাজধানীবাসীর ট্রিপের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪ কোটি ২৭ লাখে। সে সময়ে বাসের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে। ৬৩ শতাংশ ট্রিপ হবে বাসে। মেট্রোরেল ও বিআরটিতে মাত্র ৬ শতাংশ ট্রিপ হবে। এছাড়া সে সময় ব্যক্তিগত গাড়িতে ৯, অটোরিকশায় ৮, রিকশায় ১২ ও মোটরবাইকে ২ শতাংশ ট্রিপ হবে।
তথ্যমতে, ৪৭ শতাংশ ট্রিপের জন্য রাজধানীতে পর্যাপ্ত বাস-মিনিবাস নেই। ফলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে নিয়মিতই বাস যাত্রীদের লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। আবার বাসে উঠলেও দুর্ভোগের শেষ থাকে না। তাই রাজধানীর বাস সার্ভিসের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে একটি রুটে বৃহৎ একটি কোম্পানির বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এক্ষেত্রে এক রুটের বিদ্যমান বাসগুলোকে একটি কোম্পানিতে পরিণত করতে হবে, যা ‘বাস রুট ফ্রানচাইজ’ নামে পরিচিত হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, গত ছয় বছরে ঢাকায় বাস-মিনিবাস নেমেছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। চলতি বছর মে পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ হাজার। এর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ তিন হাজার ৬৪৩টি বাস-মিনিবাস নেমেছে রাজধানীতে। এছাড়া ২০১৫ সালে দুই হাজার ৩২৪টি, ২০১৪ সালে এক হাজার ৪৭৩টি, ২০১৩ সালে এক হাজার ৫৪টি, ২০১২ সালে এক হাজার ৩৪৩ ও ২০১১ সালে এক হাজার ৬৩৭টি। এত বাস নামলেও জনগণের ভোগান্তি কমেনি।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে জানান, বিশ্বব্যাংক এক দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার বাস রুট ফ্রানচাইজের কথা বলছে। এতে বাসগুলোর যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বাড়বে। পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বরাবরই এতে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ফলে এটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
এদিকে ২০১৫ সালের তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, প্রতিদিন ঢাকার পথে চলাচল করে প্রায় পাঁচ হাজার বাস। তবে এগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। এতে রাজধানীর বাসপ্রতি যাত্রী চলাচল করতে পারছে বিশ্বের জনবহুল বিভিন্ন শহরের তুলনায় অর্ধেকের কম।
এতে দেখানো হয়, রাজধানীতে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। আর বাস কোম্পানি রয়েছে ১৩৭টি। এদের মধ্যে শতাধিক বাস রয়েছে মাত্র সাতটি কোম্পানির। ৭৫টি কোম্পানির মালিকানায় ৫০টির কম সংখ্যক বাস। আর ৮৫০টি বাসের মালিক পৃথক পৃথক ব্যক্তি। এতে একই রুটে চলে বিভিন্ন কোম্পানির বাস। আবার কিছু রুটে ব্যক্তি মালিকানার বিভিন্ন বাস-মিনিবাস চলাচল করে। ফলে প্রতিযোগিতা লেগেই আছে।
এতে আরও বলা যায়, ঢাকার ৬ হাজার বাসে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চলাচল করে। অর্থাৎ বাসপ্রতি দৈনিক ৫০০ যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের মুম্বাই শহরে বাস রয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৬০০টি। তবে এসব বাসে যাত্রী বহন করা হয় দৈনিক গড়ে ৪৮ লাখ। অর্থাৎ বাসপ্রতি যাত্রী পরিবহনের হার ১ হাজার ৩৩৩। আর সিঙ্গাপুর শহরে বাস রয়েছে ৩ হাজার। এর মাধ্যমে ঢাকার চেয়ে বেশি প্রায় ৩২ লাখ যাত্রী দৈনিক পরিবহন করা হয়। এক্ষেত্রে বাসপ্রতি যাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৭।
জানতে চাইলে গবেষণা পরিচালনাকারী বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সিঙ্গাপুর ও মুম্বাইয়ে রয়েছে পরিকল্পিত বাস নেটওয়ার্ক। এক রুটে চলাচল করে একটি কোম্পানির বাস। এজন্য এত বেশিসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করা যায়। আবার বাসগুলোয় যাত্রীদের খুব বেশি ভিড়ও হয় না। অথচ ঢাকার বিভিন্ন বাসে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকে সব সময়ই। যাত্রীদের মধ্যেও বাসে ওঠার জন্য প্রতিযোগিতা লেগে যায়। অনেক যাত্রী নিয়মিতই দাঁড়িয়ে এমনকি দরজায় ঝুলেও যাতায়াত করেন।
তিনি আরও বলেন, গত এক দশকে বাসে যাত্রী চলাচলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে পরিকল্পিত বাস নেটওয়ার্ক না গড়ে তোলা গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব বাস রুট ফ্রানচাইজ করে একটি রুটে বাস পরিচালনার দায়িত্ব একটি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিতে হবে।