বিশ্বজুড়ে আধুনিকায়নের ফলে ইলেকট্রনিকস পণ্যগুলো আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসে পরিণত হয়েছে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে জোগানের
সামঞ্জস্য বজায় রাখতে তাই উদ্যোক্তারা দেশের অভ্যন্তরেই ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন শুরু করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে টেলিভিশন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে তারা তৈরি করছে ২০টিরও অধিক ইলেকট্রনিকস পণ্য, যা দেশীয় বাজারে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বদরবারে নিজেদের উপস্থাপন করতে। উন্নত প্রযুক্তি আর মানে ভালো, কিন্তু দামে কম এ ব্যাপারগুলোর সমন্বয়সাধন করে তারা পণ্য তৈরি করছে বলে আজকে বাংলাদেশের বাজারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে তাদের পণ্য পৌঁছে গেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেছেন মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি এমএ রাজ্জাক খান রাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বীর সাহাবী
মিনিস্টার গ্রুপের যাত্রা শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? বিনিয়োগ ছিল কেমন?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: উচ্চ মাধ্যমিক শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর গমন করি। কিন্তু সব সময়ই ইচ্ছা ছিল দেশে কিছু করার। তাই ১৯৯৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসি। সে সময় বিশ্বমানের একটি দেশীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের অভাব বোধ করছিলাম। ২০০২ সালে মাত্র পাঁচ কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করি। তখন মূলধন ছিল মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। আমরা ২০০৫ সালে প্রথম ফ্রিজ অ্যাসেম্বলিং শুরু করি এবং ২০১৩ সাল থেকে নিজস্ব কারখানায় ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করি। সবার সহযোগিতা ও ভালোবাসায় আমরা সফলতার সঙ্গে ২১ বছর পার করলাম। দেশের মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন ছাড়া আমরা এতদূর আসতে পারতাম না। এই সফলতার পেছনে সব থেকে বড় অবদান ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার সহযোগিতায় আজ আমরা দেশীয়ভাবেই সব ধরনের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই দেশের সুপরিচিত ব্র্যান্ড হিসেবে আমরা জনপ্রিয়তা অর্জন করি এবং দেড় যুগ পেরিয়ে গেলেও সেই জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। ধন্যবাদ সেসব গ্রাহকের প্রতি, যাদের আস্থা ও বিশ্বাসে আমরা আজ এই অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
কবে থেকে উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেছে মিনিস্টার?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: ২০০২ সালে সাদাকালো টেলিভিশন উৎপাদন শুরু করি। প্রথমে সাদাকালো টিভি, এরপর রঙিন। এখন তো বেসিক এলইডি, স্মার্ট ও ফোর-কে টিভি উৎপাদন করছি। ২০০৫ সালে ফ্রিজ অ্যাসেমব্লিং শুরু করি। এরপর ২০১৩ সাল থেকে নিজেরাই উৎপাদন করছি। এসি উৎপাদন করছি ২০১৭ সাল থেকে। এছাড়া উৎপাদন করছি বিভিন্ন ধরনের হালকা ও মাঝারি হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য। গরমের মৌসুমে প্রায় ২৫-৩০ হাজার ফ্রিজ উৎপাদনসহ বার্ষিক অন্তত চার লাখেরও বেশি ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকি। এছাড়া বার্ষিক ৫০ হাজারেরও বেশি টিভি এবং ২০ হাজারেরও বেশি এসি আমরা উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকি। মিনিস্টারই প্রথম ফ্রিজ ও ইনভার্টার এসিতে ১২ বছর গ্যারান্টি দিয়েছে এবং নির্দিষ্ট মডেলের টিভিতে প্যানাল ও পার্টসে পাঁচ বছর গ্যারান্টিসহ সার্ভিসে ১০ বছরের ওয়ারেন্টি রয়েছে। দেশের সব জেলায় নিজস্ব শোরুম ও ডিলার ফ্র্যাঞ্চাইজিং শোরুম রয়েছে এক হাজারের বেশি। ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রিতে বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন মিনিস্টারের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে।
মিনিস্টার ফ্রিজ নিয়ে কিছু বলুন।
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: বিভিন্ন দামে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজ তৈরি করে থাকে মিনিস্টার। মিনিস্টারের রয়েছে স্পেসিফিকেশন, আকৃতি ও ডিজাইন। প্রতিটি পণ্যের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করেই দামের ভিন্নতা রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি ফ্রিজে যুক্ত করা হয়েছে এমন সব প্রযুক্তি, যা সঠিক তাপমাত্রা ও হিমায়িত খাবারের ভিটামিন এবং দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে। সম্পূর্ণ অটোমেটিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ফ্রিজ। একইসঙ্গে ৬৬ শতাংশ এনার্জি সেভিং কম্প্রেসার ব্যবহার করা হয়, যার ফলে প্রতিটি ফ্রিজ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী।
ফ্রিজ ছাড়া আর কী কী পণ্য উৎপাদন করছেন?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: মিনিস্টারের প্রডাকশন লাইনে রেফ্রিজারেটর ছাড়াও রয়েছে ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, এলইডি টিভি, স্মার্ট এলইডি টিভি, ব্লেন্ডার, গ্রিন্ডার, রাইসকুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক ক্যাটলি, ফ্যান, আয়রনসহ ২০টিরও বেশি পণ্য। এছাড়া কভিড মহামারির সময় মিনিস্টার হিউম্যান কেয়ারির মাধ্যমে ডিটারজেন্ট, হ্যান্ডওয়াশ, মাস্কসহ বিভিন্ন জরুরি পণ্য বাজারে নিয়ে আসি। ২০২২ সালে ইরাজ ডট কম নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠা করে নতুনভাবে গ্রাহকদের ই-কমার্স সেবা নিশ্চিত করছি আমরা। বাজারে এসব পণ্যের বিপুল চাহিদার কথা চিন্তা করেই আমাদের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
বছরের কোন সময় ফ্রিজ বেশি বিক্রি হয়? তখন কী ধরনের প্রতিযোগিতা করতে হয়?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: সাধারণত গরমের মৌসুমে দেশের বাজারে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) এবং ফ্রিজের চাহিদা ও বিক্রি বেড়ে যায়। এবারের গ্রীষ্মে তো প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে, যে কারণে ফ্রিজ বিক্রি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি এসি ও ফ্যানের বিক্রিও ভালো। এই সময়টাতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পণ্য বিক্রিতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তবে এই প্রতিযোগিতায় আমরা সর্বদাই এগিয়ে, কারণ আমরা পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য উৎপাদন করে থাকি এবং সুলভ মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে থাকি। আমরা কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমরা সব থেকে ভালো পণ্য বাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা করি, যা আমাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে। মান ও গুণের সমন্বয়ে তৈরি আমাদের পণ্য, তাই বাজারে সর্বজনগৃহীত। প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য আমরা কখনও মানের পরিবর্তন করি না, যার ফলে সুবিবেচক ক্রেতারা আমাদের পণ্যই কিনে থাকেন।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতের কতটা অগ্রগতি হচ্ছে?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস শিল্প বর্তমানে দ্রুত বর্ধনশীল এবং সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। আর এই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে বেসরকারি খাত। তার মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে ইলেকট্রনিকস শিল্প। আমি মনে করি, দেশীয় ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য খাতের বিকাশের ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আমদানি কমায় ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। এ শিল্প হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে পুরো বিশ্বে আমাদের ইলেকট্রনিকস পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করছি।
এই খাতের উন্নয়নে কী কী সমস্যা রয়েছে? সরকারের কী ধরনের নীতিসহায়তা দরকার?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: পণ্য উৎপাদনের মৌলিক উপাদান হলো কাঁচামাল। বাংলাদেশে শিল্পের কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়, যা এই খাতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মূল কারণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্পগুলোর জন্য আরও এক থেকে দুই বছর কর সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। স্থানীয় শিল্পের সক্ষমতা অর্জনে বিদ্যমান সুবিধা আগামী এক থেকে দুই বছর বাড়ানো হলেও হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এতে পণ্যমূল্য বাড়বে এবং শিল্পের সক্ষমতা কমবে। হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, সিমেন্ট, মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু খাত রিডিউসড রেটে (হ্রাসকৃত হারে) মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রদান করছে (নিয়মিত ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ)। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, এই খাতগুলোকে এখন কিছুটা বেশি (৭.৫ শতাংশ) হারে ভ্যাট দিতে হবে, তবে এক থেকে দুই বছরের জন্য হ্রাসকৃত করহারের সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবে বলে তুলে ধরা হয়েছে এই বাজেটে। আমরা এখনও দেশের অভ্যন্তরে কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারিনি। সুতরাং আমরা আশা করি, সরকার এই বিষয়টি বিবেচনা করে করের পরিমাণ হ্রাস করবে।
ক্রেতার রুচি-পছন্দের সঙ্গে ফ্রিজ উৎপাদনকারীদের কীভাবে তাল মেলানো দরকার?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে, ক্রেতাদের চাহিদা ও রুচিরও তেমন পরিবর্তন ঘটছে, যার ফলে আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের থাকতে হচ্ছে আরও বেশি সক্রিয়। ভোক্তারা সবসময় আশা করে কম টাকায় ভালো ও উন্নত পণ্য কেনার। আর তাদের কথা চিন্তা করে মিনিস্টার গ্রুপ দেশের মধ্যেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করছে নানা মডেলের ও নানা ডিজাইনের পণ্য। সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে আমরা সবসময় পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার করে থাকি, যা আমাদের করেছে অন্যদের থেকে অনন্য। আমি মনে করি, প্রতিটি উদ্যোক্তারই উচিত ক্রেতাদের চাহিদার কথা চিন্তা করে তাদের পণ্য তৈরি করা।
মিনিস্টার গ্রুপের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
এমএ রাজ্জাক খান রাজ: ‘লক্ষ্য এবার বিশ্বজয়’ এই সেøাগানকে লালন করে মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ দেশের অন্যতম সেরা ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের মিনিস্টার-মাইওয়ান গ্রুপ একটি শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের প্রতিযোগী হিসেবে থাকবে বলে আশা রাখি। শুধু স্থানীয় ইলেকট্রনিকস বাজারেই নয়, আমাদের উপস্থিতি প্রসারিত হচ্ছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারেও। দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রতিটা দেশে পৌঁছে দিতে চাই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তখন মিনিস্টারের পণ্যই হবে আমাদের দেশের অ্যাম্বাসেডর। এছাড়া গ্রাহকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমরা আমাদের পণ্যকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে পণ্যগুলোর ব্যপক সমৃদ্ধিসাধন করছে আমাদের দক্ষ টিম। বিভিন্ন কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে দেশীয় বাজারে শেয়ার বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা নিরন্তন কাজ করে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, আমরা একটি ই-কমার্স সাইট ‘ই-রাজ’ প্রবর্তন করেছি দেশব্যাপী বিস্তৃত গ্রাহকদের সন্নিকটে পৌঁছানোর জন্য।